যখন আল্লাহর সরাসরি আদেশ অমান্য করেছিল সে আল্লাহকেই দোষারপ করেছিল (নাউযুবিল্লাহ) সে বলেছিল নিশ্চয়ই আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, অতএব আমি মানুষকে পথভ্রষ্ট করব। অন্যদিকে আদম আলাইহিস সালাম নিজের ভুলের দায়ভার পুরোপুরি নিজের কাঁধে নিয়ে আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে বলেছেন, আল্লাহ যদি তাকে ক্ষমা না করেন তার আর কোন আশা থাকবে না তার আর কোন উপায় থাকবেনা এবং আল্লাহ আদম আলাইহিস সালাম ও মা হওয়ার দোয়া কবুল করলেন কিন্তু তাদেরকে এও আদেশ করলেন যেহেতু তারা সেই গাছের ফল খেয়ে ছিল তাই তাদেরকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীতে কাটাতে হবে।
মুসলিম শরীফের হাদীসে এসেছে আল্লাহ তা’আলা আদম আলাইহিস সালামকে শুক্রবারে সৃষ্টি করেছেন, তাকে শুক্রবারে জান্নাতে প্রবেশ করিয়েছেন, আর শুক্রবারেই তাকে সেখান থেকে বের হয়ে যেতে হয়েছিল।
আদম আলাইহিস সালাম আর মা হাওয়া পৃথিবীর দুটি আলাদা স্থানে অবতীর্ণ হলেন, তাঁরা ঠিক কোথায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন সে বিষয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে, তবে সব বর্ণনাই যা আসে তা হলো তারা দুজন পৃথক পৃথক জায়গায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। জান্নাতের মতো জায়গায় একে অপরের মধুর সঙ্গ পাওয়ার পর দুনিয়ার মতো জায়গায় এসে নিঃসঙ্গ দিন কাটানো অনেক বড় একটা পরীক্ষা ছিল।
একবার ভেবে দেখুন আপনার জীবন সঙ্গী যাকে আপনি সবসময় কাছে পাচ্ছেন, ঘরে ফিরলেই যার দেখা হয় যাকে ঘিরে আপনার সব পরিকল্পনা। তাকে যদি হঠাৎ করে আপনি হারিয়ে ফেলেন এবং কতদিনের জন্য আপনি হারিয়ে ফেলেছেন আপনি জানেন না এবং আপনি যেই রবের কাছে দোয়া করছেন আপনার ভয় হচ্ছে, সেই রব আপনার উপর রেগে আছেন।
আপনি এমন একটি জায়গায় আছেন যা অন্ধকার যা ভয়ানক এবং আপনি জানেন না আপনার জীবনসঙ্গী কেমন জায়গায় আছেন। এমন অবস্থায় নিজেকে কতটা অসহায় মনে হবে তারা ব্যাকুল হয়ে একে অপরকে খুঁজতে লাগলেন, খুঁজতে খুঁজতে কতদিন হয়ে গেল তার কোনো নির্দিষ্ট হিসেব নেই। কিন্তু অবশেষে তারা একে অপরকে খুঁজে পেলেন এবং মা হওয়া এবং আদম আলাইহিস সালাম তাদের দুনিয়ার জীবনের সংসার শুরু করলেন।
বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে আদম আলাইহিস সালাম দুনিয়াতে প্রায় এক হাজার বছর বেঁচে ছিলেন এবং এই সময়ে মা হওয়া অনেকবার মা হয়েছিলেন এবং প্রতিবার তার কোলে আল্লাহর হুকুমে যমজ সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল এবং সেই সময়ের বিধান ছিল এক কোলের সন্তানকে আরেক কোলের সন্তানের সাথে বিয়ে করতে হবে।
অর্থাৎ যেহেতু তখন প্রতিটি মানুষই সরাসরি একে অপরের ভাইবোন ছিল তখন ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করার নিষেধাজ্ঞা জমজ ভাই বোনদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। আদম আলাইহিস সালামের প্রথম পুত্র সন্তানের নাম ছিল এবং এরপর এর পুত্র সন্তানের নাম ছিল হাবিল। কাবিল ছিল কৃষক আর হাবিল পশুপাখি পালত। কাবিল ছিল কিছুটা রাগী প্রকৃতির এবং সে হাবিলের বোনকে বিয়ে করার ব্যাপারে অসম্মতি জানাল। তার দৃষ্টিতে তার নিজের বোন ছিল আরো বেশি রূপবতী। এই অবস্থায় আদম আলাইহিস সালামের মাধ্যমে ওহী আসল তারা দুই ভাই যেন আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী করে এবং কোরবানি কবুল হবে তার পছন্দই চূড়ান্ত হবে।
হাবিল তার খামার থেকে সবচেয়ে সুন্দর পশুটি আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী করল, অন্যদিকে কবিল তার সবচেয়ে খারাপ ফসলটি কোরবানির নিয়তে উঠিয়ে রাখল এবং হাবিলের কোরবানি কবুল করলেন এবং কবিলের কোরবানি কবুল হলো না। এবং হাবিলের আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী কবিলের বোনকে বিয়ে করার জন্য সম্মতি জানাল। কিন্তু এতে কবিলের অন্তর হিংসা-বিদ্বেষ ভরে গেল এবং সে একপর্যায়ে হাবিলকে বলল সে হাবিলকে হত্যা করে ফেলবে।
হাবিল তার ভাইকে বলল তুমি আমাকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়ালেও আমি তোমাকে হত্যা করার জন্য হাত বাড়াবো না, কারণ আমি আল্লাহকে ভয় করি এবং তার কথা শুনে কাবিল আরো ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলো এবং হাবিলকে হত্যা করার জন্য তার গলা চেপে ধরলো কিন্তু তাকে হত্যা করতে পারল না। তখন ইবলিশ তাদের কাছে আসলো এবং হাবিলকে হত্যা করার পদ্ধতি শেখানোর জন্য একটি পশুর মাথায় পাথর দিয়ে পশুটিকে হত্যা করল এবং কবিল একিভাবে একটি পাথর নিয়ে হাবিলের মাথায় আঘাত করলো এবং এভাবেই হাবিল হয়ে গেল মানব ইতিহাসের প্রথম শহীদ হয়ে গেল মানব ইতিহাসের প্রথম হত্যাকারী।
যতক্ষণ পর্যন্ত আদম আলাইহিস সালাম এর কাছে খবর এলো ততক্ষণে তার কর্মের পরিনাম এর কথা চিন্তা করে পালিয়ে গিয়েছে, সে ভাবল তার আর কোনো আশা নেই। আদম আলাইহিস সালাম ও মা হাওয়া তার দুই সন্তানকে এভাবে হারিয়ে বুকের গভীর শোক ধারণ করে তাদের বাকি সন্তানদের সদুপদেশ দিতে থাকলেন এবং আল্লাহর এবাদত করার জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করতে থাকলেন। ধীরে ধীরে বহু বছর পার হয়ে গেল এবং তাদের অনেক সন্তান জন্ম হলেও কেউ কেউ বলেন মা হওয়ার ২০ জোড়া যমজ সন্তান হয়েছিল, আবার কেউ কেউ বলেন সে সংখ্যা একশোর বেশী এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার কোন উপায় নেই।
তবে তাদের সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে একজন সন্তান ছিলেন শীষ, যে তার বাবার মতো সমাজের মানুষকে ভাল কাজ করার উপদেশ দিতেন এবং খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিতেন। আদম আলাইহিস সালাম যখন অনেক বৃদ্ধ তখন একদিন তিনি ফল খাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, বাস্তবে তার জান্নাতের ফলের কথা খুব মনে পড়ছিল এবং তিনি সেই ফলই খেতে চাচ্ছিলেন।
কিন্তু তার সন্তানেরা যখন শুনলো তাদের বাবা ফল খেতে চাচ্ছেন তারা দ্রুত বেরিয়ে পড়ল সেই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ ফল নিয়ে আসার জন্য। তারা যখন ফলের সন্ধানে জঙ্গলে গেল তখন সেখানে তাদের কিছু ফেরেশতাদের সাথে দেখা হয় সেই ফেরেশতারা বলল তোমাদের বাবা যে ফল চেয়েছেন তা এখানে নেই, তোমরা বরং তার কাছে ফিরে যাও এবং আমরাও তার সাথে সাক্ষাৎ করব।
আদম আলাইহিস সালামের সন্তানেরা যখন সেই ফেরেশতাদের নিয়ে বাড়ী ফিরল তখন সেই ফেরেশতাদের একজন কে চিনতে পারলো। কারণ সেই ফেরেশতা এর আগেও একবার দেখা দিয়েছিল যখন তার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছিল। তিনি বুঝতে পারলেন মালাকুল মাওত তার স্বামীর আত্মাকে নিতে এসেছে। জান্নাতে বহু বছর সুখে শান্তিতে কাটানোর পর যখন তাদেরকে দুনিয়াতে পাঠানো হয়েছিল তখন যে
সময়টা মা হাওয়া আদম আলাইহিস সালামকে ছাড়া একাকী কাটিয়েছিলেন সেই কষ্টকর সময়ের কথা তার মনে পড়ে গেল, এবং তিনি মালাকুল মাওতকে বাধা দিলেন।
কিন্তু আদম আলাইহিস সালাম মা হাওয়াকে বুঝিয়ে বললেন তাকে তার রবের কাছে ফিরে যেতে হবে। অবশেষে মা হাওয়া সরে দাঁড়ালেন এবং মালাকুল মউত আদম আলাইহিস সালামের আত্মা নিয়ে নিলেন। তারা আদম আলাইহিস সালাম এর মরদেহকে গোসল করালেন দাফন করলেন এবং মাটিতে কবর দিলেন এবং সেই প্রথা আমরা আজ পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।
আদম আলাইহিস সালামের মৃত্যুর সময় মানব সমাজ অনেকটাই বড় হয়ে গিয়েছিল এবং সেখানে ভালো কাজের পাশাপাশি নানা ধরনের পাপ কাজ বাড়তে লাগল এবং এই অবস্থায় আল্লাহর বাণী প্রচার করার কাজে নামলেন আদম আলাইহিস সালামের সন্তান শীষ আলাইহিস সালাম।
সংকলনেঃ এম.এ.এস ইমন
প্রকাশক, দৈনিক ‘মেহেরপুর প্রতিদিন’