দীর্ঘ চার বছরের বেশি সময় পর মিয়ানমারে গিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু নিয়ে আবারও আলোচনায় বসছে বাংলাদেশ। ৪ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের প্রশাসনিক রাজধানী নেপিডোতে দুই দেশের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে। একইসময়ে ঢাকায় বিরোধীদলীয় নেতৃত্ব প্রত্যাবাসন নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয় বলছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ‘পাইলট প্রকল্প’ দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়িত হবে। তিনি মিয়ানমারে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনে আলোচনার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে ‘সক্রিয় ভূমিকার’ জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান।
এদিকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন অফিস বলছে, রোহিঙ্গাদের থাকার কোন সমস্যা যেন না হয় সেখানে বাংলাদেশ সরকারে কোন ছাড় দেয়নি। প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই। কিন্তু সেখানে এতো সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখছে বাংলাদেশ।
দলের স্বার্থে না, দেশের স্বার্থে কথা বলতে আহ্বান
সোমবার যখন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে সরকার আলোচনা এগিয়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছে তখনই অকষাৎ বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার প্রত্যাবাসন নিয়ে ‘শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে’ বলে উল্লেখ করে বক্তব্য রাখেন। তার এই বক্তব্যকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ সরকার ভূরাজনৈতিক দিকগুলো বিবেচনা করে প্রত্যাবাসনের কাজটি করে যাচ্ছে। বিষয়টির আগে পিছে না জেনে এইধরনের মন্তব্য করা রাজনৈতিক নেতাদের উচিত না বলে অভিমত তাদের।
উল্লেখ্য, শুরু থেকেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে সুনাম কুড়িয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ফিরিয়ে দেওয়া বিষয়ে যে মোটিভেশন দান সেটাও বেশ সতর্কতার সাথে সফলভাবে করতে সক্ষম হয়েছে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মূল প্রশ্ন হলো, তারা ফিরে যেতে নিরাপদ বোধ করছে কিনা। তারা যদি নিরাপদ বোধ না করে, তাহলে জোর করে ফেরত পাঠাবে না বাংলাদেশ। কারণ স্বেচ্ছায়, নিরাপদে ও সম্মানের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন চায় ঢাকা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ মনে করেন যখন অনেকগুলো দেশ কোন একটা সমস্যার সাথে যুক্ত তখন কূটনৈতিকভাবে সবগুলো দেশকে নিয়ে সমস্যা মোকাবিলা চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জিং কাজে যখন গতি আসে তখনই আভ্যন্তরীণ রাজনীতিক দলগুলো যদি অপ্রয়োজনীয় কথা বলে সেটা তাদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য, সেটা কখনোই দেশের স্বার্থে নয়। তিনি বলেন, বহির্বিশ্বের সাথে কূটনীতি নিয়ে আভ্যন্তরীন রাজনীতিকরা মন্তব্য না করা ভালো না। কিন্তু এরা মনে করে যদি কোন সাকসেস স্টোরি তৈরী হয় তাহলে শাসকদল সেই সুবিধা পাবে। সেই জায়গা থেকে কথা বলতে থাকে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আদৌ সফলতা আসছে কিনা সেটা নিয়ে এখন মন্তব্য করার সময় আসেনি। এইরকম একটা জটিল সমস্যা চট করে সমাধান হয়ে যাবে তা কখনোই মনে করা ঠিক না।
১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার প্রতি মানবিকতা
শুরু থেকেই সীমান্ত খুলে দিয়ে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া এবং তাদের তত্ত্বাবধানে অসামান্য ভূমিকা রাখায় সরকারকে ধন্যবাদ দেয় বিভিন্ন আন্তর্তাতিক সংস্থা। ২০২১ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস মিয়ানমারে নৃশংসতা আর নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরাটা টেকসই করতে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বাংলাদেশকে আশ্বস্তও করেন।
এদিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম আশাবাদ ব্যক্ত করে সম্প্রতি বলেছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ‘পাইলট প্রকল্প’ দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বাস্তবায়িত হবে। দ্রুত প্রত্যাবর্তনে আলোচনার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগে ‘সক্রিয় ভূমিকার’ জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান।
এক মিলিয়নের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ মানবিকতার এক অনন্য উদাহারণ সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য এড কেইস সম্প্রতি ক্যাম্প সফর শেষে বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে আলাপ করেছি। আলাপকালে রোহিঙ্গারা তাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়া, লেখা-পড়ার ব্যবস্থা, বর্তমান জীবনযাপন নিয়ে কথা বলেছেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গারা তাদের দেশ মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্য আমাদের কাছে দাবিও জানিয়েছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণের জন্য বাংলাদেশের সরকার ও জনগণকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলছেন, রোহিঙ্গাদের থাকার কোন সমস্যা যেন না হয় সেখানে বাংলাদেশ সরকারে কোন ছাড় দেয়নি। প্রত্যাবাসনের বিকল্প নেই। কিন্তু সেখানে এতো সংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তার বিষয়টিকেও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেখছে বাংলাদেশ। এই ছয় বছরে একের পর এক সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। বাংলাদেশ তার ভূরাজনীতি বিবেচনায় রেখে প্রতিটা সম্ভাবনাকেই কাজে লাগাতে চেয়েছে। তবে সবসময়ই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কত পরিকল্পিতভাবে ফেরত পাঠানো যায় সেটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।