বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা, সুষম পুষ্টি, বেকার সমস্যার সমাধান ও আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, কৃষি জমির উর্বরতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নত মেধা সম্পন্ন জাতি গঠনে কৃষি খামারের ভূমিকা অপরিসীম। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ধারা ৭, ৯, ১০, ১৪, ১৫ এবং ১৬ অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর করতে বলা হয়েছে। এই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সূচিত পথ ধরে তারই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতায় এসে দরিদ্র মানুষের জন্য ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের একটি ধারণা তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলীকে প্রদান করেন।
প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন তখন দেশের সমৃদ্ধ ইকোসিস্টেমকে ব্যবহার করে প্রতিটি গ্রামের বাড়িতে কৃষি, মৎস্য চাষ, পশুপালন ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে কার্যকর খামারবাড়ি হিসেবে গড়ে তোলা। এই ধারণার কার্যকারিতা পরীক্ষা করার লক্ষ্যে প্রথমে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায় একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প পরিচালনা করে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ধারণাটি পরিবার পর্যায়ের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি তথা আয় সঞ্চারণে বেশ কার্যকর।
এই প্রেক্ষাপটে একনেক কর্তৃক জুলাই ২০০০ সাল থেকে জুন ২০০৫ মেয়াদের জন্য ১৪১০৮.০২ লক্ষ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয় এবং এর বাস্তবায়ন শুরু হয়। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হলে তৎকালীন সরকার প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়।
২০০৯ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পুনরায় সরকার গঠন করলে আমার বাড়ি আমার খামার নামে প্রকল্পটি আবার কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধারাবাহিকভাবে সরকার গঠনের ফলে প্রকল্পের মেয়াদ সর্বশেষ ২০২১ সাল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।
প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পল্লী এলাকায় বসবাসকারী দরিদ্র মানুষদের সংগঠিত করে ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে তাদের মধ্যে সঞ্চয় প্রবণতা বৃদ্ধি ও স্থায়ী ঘূর্ণায়মান তহবিল গঠন করা, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং গঠিত তহবিল পারিবারিক বলয়ে আয়বর্ধক কৃষিজ খামার স্থাপনে বিনিয়োগ করা এবং জীবিকা উন্নয়নের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করা।
প্রকল্পের আওতায় একেকটি গ্রাম থেকে ৬০টি দরিদ্র পরিবার নির্বাচন করে ৪০ জন নারী এবং ২০ জন পুরুষ নিয়ে একটি সমিতি গঠন করা হয়। এই সমিতির সদস্যরা মাসে ২০০ টাকা হারে সঞ্চয় করেন। সদস্যদের সঞ্চয় জমা একনাগাড়ে ২৪ মাস পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়। ৬০ জন সদস্য ২৪ মাসে ২০০ টাকা হারে সঞ্চয় করলে দুই বছরে ২.৮৮ লক্ষ টাকা সঞ্চয় জমা হয়।
সদস্যদের সঞ্চয়ের বিপরীতে প্রকল্প থেকে সমপরিমাণ অর্থ (সদস্য প্রতি মাসে ২০০ টাকা হারে ২৪ মাস) উৎসাহ সঞ্চয় বা বোনাস হিসেবে অনুদান প্রদান করা হয়। এটি দরিদ্র সদস্যদের তাদের কষ্টার্জিত দৈনন্দিন আয় থেকে সঞ্চয় করতে অনুপ্রাণিত করে।
এছাড়া গ্রাম উন্নয়ন সমিতির নিজস্ব স্থায়ী তহবিল গঠনের জন্য প্রকল্প থেকে প্রতি সমিতিতে বছরে ১.৫০ লক্ষ টাকা করে দুই বছরে ৩ লাখ টাকা ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে অনুদান প্রদান করা হয়। সদস্যদের নিজেদের সঞ্চয় ও প্রকল্প থেকে সঞ্চয়ের বিপরীতে প্রদত্ত উৎসাহ সঞ্চয় বা কল্যাণ অনুদানের সাথে ঘূর্ণায়মান তহবিল হিসেবে অনুদান যোগ হয়ে প্রতি সমিতির জন্য দুই বছরে ৯ লাখ টাকার একটি স্থায়ী তহবিল গড়ে ওঠে।
এই অর্থের মালিক সমিতি। সমিতির সদস্যরা এই অর্থ স্থায়ীভাবে আয়বর্ধক খামার করতে ব্যবহার করে। এছাড়া প্রকল্পের আওতায় সমিতির সদস্যদের দক্ষ খামারি হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়।
জুলাই ২০০৯ থেকে জুন ২০২১ মেয়াদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষুদ্র সঞ্চয় দর্শন অনুসরণে বাস্তবায়িত ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের অধীনে মোট গ্রাম সমিতি গঠিত হয়েছে ১,২০,৩২৫টি। দরিদ্র সদস্যদের ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের পরিমাণ ২০৮৬ কোটি টাকা। গ্রাম সমিতির জন্য মোট তহবিল গঠিত হয়েছে ৭৬০৯ কোটি টাকা। সদস্যদের বাড়িতে পারিবারিক খামার স্থাপিত হয়েছে ৩৩ লক্ষ ৩৭ হাজার।
এটি এখন স্বীকৃত যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষুদ্র সঞ্চয় দর্শন ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে একদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য যেমন বিপুল পরিমাণ তহবিল স্থায়ীভাবে সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে তেমনি অপরদিকে দেশের দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে।
২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দরিদ্রতার হার প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং অতি দরিদ্রতার হার হ্রাস পেয়ে এক তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে। বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত হয়েছে। যারা পূর্বে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক সেবা বহির্ভূত ছিল, পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক এইসব পরিবারদের ক্ষুদ্র মাঝারি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করেছে, যা বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে।
ক্ষুদ্র ঋণের পরিবর্তে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিকল্প ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ হয়ে উঠেছে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দিন বদলের হাতিয়ার।
লেখক: সার্জারি এন্ড থেরিওজেনোলজি বিভাগ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।