মহান আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কুরআনে কারীমায় ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর ইতাআত (আনুগত্য) কর, রসূলের ইতাআত কর এবং উলিল আমরের ইতাআত কর।’ (সূরা আন নিসা; ৫৯)
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় হযরতে ওলামায়ে কেরাম বলেছেন, মহান আল্লাহ তা’য়ালার আনুগত্য রসূলের মাধ্যমে। আর আল্লাহর ও রসূল উভয়ের আনুগত্য উলিল আমর বা আমীরের মাধ্যমে। তবে আল্লাহ এবং রসূলের আনুগত্য শর্তহীন এবং নিরঙ্কুশ তবে উলিল আমর বা আমীরের আনুগত্য শর্ত সাপেক্ষ এবং আল্লাহ ও রসূল প্রদত্ত সীমারেখার মধ্যে সীমিত।
ড. মুশফিক আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি! যিনি ছিলেন স্বীয় যুগের যাহেদদের সর্দার, পরহেযগারীর শিক্ষাঙ্গনের পন্ডিতপুরুষ, খ্যাতিমান দুনিয়াবিমুখ। স্বীয় যুগে তাঁর চেয়ে খোদভীরু পরহেযগার আমি আর দেখিনি। তিনি মাঝে মাঝেই আমাদের ইতাআতের পরিমাপ শেখাতেন। তিনি বলতেন, আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক জিনিসকে মেপেছেন। শুধু মেপেছেন তা নয়, ভাল করে মেপেছেন, মাপার মত করেই মেপেছেন। দুনিয়াতেও দেখা যায় যে মাপ জিনিসটা বড় গুরুত্বপূর্ণ। ঘি খুব ভাল জিনিস, কিন্তু অতিরিক্ত ঘি হয়ে গেলে খাবার নষ্ট হয়ে যাবে। ভাল জিনিস হলেই যে খুব বাড়ানো যায়, তা কিন্তু নয়।
আল্লাহ তা’য়ালা ভাল আমাল দিয়েছেন, কিন্তু আমালগুলোর মধ্যে সীমা নির্ধারন করে দিয়েছেন। নামায সবচেয়ে বড় আমাল, কিন্তু প্রতিদিনই কিছু সময় আছে যে সময় নামায নিষিদ্ধ। এটা এই কারণে যে, মাপের যে মৌলিক নিয়ম আছে, ঐটা সম্বন্ধে বান্দা যেন জ্ঞান রাখে। নামায ভাল, তাই বলে যে যখন তখন পড়বে তা কিন্তু নয়। রোযা রমযানে ফরয, অন্য সময় নফল, কিন্তু কয়েকদিন আবার হারাম। এটা সব আমালে প্রযোজ্য যে, তার একটা মাপ আছে। মাপ নষ্ট হয়ে গেলে দ্বীন নষ্ট হবে।
শয়তান মানুষকে তার বিভিন্ন ফাঁদের মধ্যে ফেলে আর এইটাও একটা ফাঁদ যে নেতৃত্বাস্থানীয় যারা আছে, এদেরকে অধিক শ্রদ্ধার উপরে উঠায়। খ্রিষ্টানরা ঈসা আলাইহিস সালামকে এতই সম্মান, শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করলো যে করতে করতে একেবারে আল্লাহর পুত্রই বানিয়ে দিল। অর্থাৎ সীমা লংঘন করল। আমাদের দেশে বহুত বড় মুসীবত হচ্ছে বিদআত। আর বিদআতের মূল হচ্ছে ভন্ড পীরকে মহব্বত। এসব পীরদের মধ্যে কিছু গুন থাকে। কিন্তু এটাকে এমন সীমার উর্ধ্বে নিয়ে যায় এবং ওর ব্যাপারে এত বেশি আস্থা, এত বেশি শ্রদ্ধা তৈরি হয় যে, উনার ভুল ধরা যাবে না।
কিন্তু হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহ আনহুর আমাল দেখুন।
হযরত আবু বকর রাযিয়াল্লাহু আনহু এক খুতবায় বলেন, তোমরা আপন দৃষ্টি দ্বারা আমার দেখাশোনা করবে। যদি আমি সোজা চলি তবে আমার সাহায্য করো। আর যদি আমি বাকা চলি তবে তোমরা আমাকে সোজা করে দিও। যদি আমি আল্লাহ তা’য়ালাকে মান্য করি তবে তোমরা আমার কথা শুনো, আর যদি আমি আল্লাহ তা’য়ালাকে অমান্য করি তবে তোমরা আমাকে অমান্য করো।(কানয, হায়াতুস সাহাবাহ)
হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু একদিন মিম্বারে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মুসলিম সমাজ! আমি যদি কখনো দুনিয়ার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে দেই, তা হলে তোমরা কি করবে? এ কাথা বলেই তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে দিলেন। তখন তাঁর সামনে বশীর ইবনে সাদ রাযিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নিজ তরবারি কোষমুক্ত করে বললেন, হাঁ, তাহলে আমি এ তরবারি দিয়ে এ কাজ করব। এ কথা বলে তিনি গর্দান কাটার ইঙ্গিত করলেন। তিনি প্রশ্ন করলেন, তুমি কি আমার গর্দান কাটার ইঙ্গিত করছ। তা শুনে তিনি তিন বার তাকে ধমক দিলেন। তিনিও তিনবার পাল্টা ধমাক দিলেন। তখন হযরত ফারুকে আজম রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আল্লাহ তোমার ওপর রহমত নাযিল করুন। আল্লাহর শোকর যে, তিনি আমার প্রজাদের ভেতর এমন লোক রেখেছেন, যে লোক আমি বাঁকা হলে আমাকে সোজা করে দেবে।(হায়াতুস সাহাবা)
ভেবে অবাক হতে হয়, আমীরুল মু’মিনীন হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু আনহু যাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে পারস্য ও রোমের সম্রাটরা পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ থাকত সাহাবায়ে কেরাম রাযিয়াল্লাহু আনহুম তাঁর সংশোধনের কথা বলতেও বিন্দু মাত্র কুন্ঠিত হননি।
মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি ট্রেনে যাচ্ছিলেন। থার্ড ক্লাসের টিকিট কিনে ভিড়ের কারণে বাধ্য হয়ে উঠেছেন সেকেন্ড ক্লাসে। টিটি এসেছে আর এসে বকাবকি করেছে। উনিও পাল্টা জবাব দিয়েছেন আর বললেন যে টিকিটের অতিরিক্ত ভাড়া তো দেওয়ায় হচ্ছে। খাদিম ছিলেন মাওলানা ইনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি, ছোট বাচ্চা। উনি হাদিস শুনিয়ে দিলেন, ‘ইন্না লিসাহিবিল হাক্কি মাকালা’ অর্থাৎ হক্ব যার আছে, তার কথা বলার অধিকার আছে।
অর্থাৎ টিটির কথা বলার অধিকার আছে, আপনার নাই। অত ব্যাখ্যা করেননি, শুধু এই কথা বলে তাই বুঝিয়েছেন। মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি বুঝতে পারলেন আর পরের স্টেশনে গিয়ে টিটির কাছে মাফ চেয়ে নিলেন। কোথায় মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি আর কোথায় মাওলানা ইনামুল হাসান রহমাতুল্লাহি আলাইহি। বয়সের কত পার্থক্য। কিন্তু বুঝতে পেরেছেন যে এই জায়গায় মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর কাজ অশুদ্ধ, তো ছোট হওয়া সত্ত্বেও সাথে সাথে সংশোধন করে দিয়েছেন। এমন না যে এটা বেয়াদবি।
এক অভিযানের ঘটনা। রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যাত্রার প্রাক্কালে অধীনস্থ সৈনিকদের হেদায়েত দিলেন, কক্ষণো আমীরের নির্দেশ অমান্য করবে না। সফরে আমীর কোন কারণে তার মামুরদের উপর ভীষণ রেগে গেলেন। তিনি সৈনিকদের জিজ্ঞেস করলেন, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি আমার আনুগত্যের নির্দেশ দেননি? তারা বললো, হ্যাঁ দিয়েছেন। তিনি আগুন জ্বালিয়ে বললেন, তোমরা এ আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়। তারা বলল, আমরা আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্যই রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করেছি, আর এখন সেই আগুনে জীবন দেব? তাঁরা আমীরের কথা মানলেন না। ফিরে এসে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ঘটনা শুনালেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের এ কাজকে সমর্থন কললেন। (আসহাবে রসূলের জীবন কথা)
সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর ‘ইসলামে রাজনৈতিক ব্যাক্ষ্যা ও বিশ্লেষণ’ কিতাবে লিখেছেন, কোন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব থেকে কোন ভুল বা বিচ্যুতি কিংবা পদস্খলন ঘটে গেলে তার উপর এ অজুহাত পেশ করে মৌনতা অবলম্বন করা যাবে না যে, তিনি নেতৃত্বের আসনে সমাসীন বা জাতির কোনো সামগ্রীক সেবা বা মহৎকাজে ব্যস্ত আছেন, তার মাধ্যমে ইসলামের ও মুসলমানদের নানাবিধ উপকার হচ্ছে বা হবে, এমতাবস্থায় তার ত্রুটি বিচ্যুতি চিহিৃত হলে এবং তাকে কোনো সঠিক পরামর্শ দিতে গেলে তার উপর অনাস্থা দেখা দেবে বা দলের মাঝে বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে।
এজন্য মনে রাখতে হবে দ্বীনের জন্য ইতাআত জরুরী তবে তার সীমারেখাও রয়েছে।
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
মহান আল্লাহ তা’য়ালা আমাদের সঠিক কথার উপর আমল করার তৌফিক দান করুন।(আমিন)
লেখক:
বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা।