শীতকাল মানেই খেজুর গুড়ের মিষ্টি সুগন্ধে ভরে যায় বাজার। আর শীত মানেই বাতাসে নলেন গুড়ের সেই মিষ্টি গন্ধ। রসগোল্লা থেকে পিঠে-পাটিসাপটা সবই এই গুড়ের সুবাসে সুবাসিত হয়। এই মিষ্টি মৌতাত পেতে আমরা শীতকালের অপেক্ষায় থাকি।
আর শীতকালে খেজুরের রস থেকে তৈরি হওয়া খেজুর গুড়ের স্বাস্থ্যগুণ অনেক বেশি। অন্যান্য গুড়ের মতোই প্রাকৃতিক বিশুদ্ধ খেজুরের গুড়ে প্রচুর পরিমাণে খনিজ আছে। এই যেমন
আয়রন– রক্তে হিমেগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক রাখতে সাহায্য করে।
পটাশিয়াম – হজমশক্তি বাড়িয়ে তোলে।
ম্যাগনেশিয়াম– মেটাবলিক রেট ঠিক রাখে এবং সেরোটোনিন নিঃসরণ সক্রিয় করে।
ক্যালশিয়াম– হাড় মজবুত করে।
তবে চোখ বুজে যে কোনো গুড়কেই ভালো ভাবলে ভুল করবেন আপনি। ভেজাল গুড় খেলে শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষতিই হয় না, খাবারের স্বাদও নষ্ট হয়। আবার শুধু গন্ধেই মজলে চলবে না, খাঁটি গুড় চিনতে না পারলে উপকারের বদলে আপনার মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
চলুন আসল গুড় আর ভেজাল গুড়ের ফারাক কীভাবে বুঝবেন জেনে নিই। আর এ বিষয়ে জানাচ্ছেন ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজির অধ্যাপক ড. প্রশান্ত কুমার বিশ্বাস।
আপনার দেখলেই মনে হবে একেবারে খাটি ও স্বচ্ছ পাতলা খেজুরের নলেন গুড়। কিন্তু সেটি কি আসল গুড়? বর্তমান বাজারে যে গুড় পাওয়া যায়, সবই যে নির্ভেজাল গুড় তা কিন্তু ঠিক নয়। দেখে ভালো মনে হলেও আসলে তা ভালো কিনা আগে সেটি যাচাই করা দরকার। তা না হলে গুড়ের গুণের বদলে মিলবে জীবন বাঁচানোর ক্ষতি।
এছাড়া গুড় মানবদেহের এনজাইম সিস্টেমকে সক্রিয় করে তোলে। খাঁটি গুড়ের মিষ্টি গন্ধ খিদে বাড়ায় এবং আমাদের মুখের থুতুতে যে টাইলিন নামক এনজাইমের নিঃসরণ হয়, সেটি বৃদ্ধি করে। যে কোনো খাবারে এই গুড় পড়লে সেই খাবার খাওয়ার ইচ্ছে খুব বেড়ে যায় আর স্বাভাবিকভাবেই হজম ভালো হয়। হজম ভালো হওয়া এবং মেটাবলিজম বেড়ে যাওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, গুড় খাওয়ার জন্য ওজন কমে। সাধারণত দেখলে হার্টের বেশিরভাগ রোগই হয় খাবার ভালোভাবে হজম না হয়ে শরীরে।
আর ভেজালে ক্ষতি
আমরা অনেকেই নলেন গুড়ে ভেজাল বলতে বুঝি চিনি মিশিয়ে মিষ্টি করা। এতে কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীদের ছাড়া অন্যদের চিন্তার কোনো কারণ নেই। কিন্তু নলেন গুড়ের সুগন্ধ বা রঙ শুধু চিনি মিশিয়ে আসে না। সে জন্যই মেশানো হয় কৃত্রিম সুগন্ধি। যেহেতু এই তথ্য জানানো থাকে না যে কী মেশানো আছে গুড়ে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে এগুলোতে কার্সিনোজেনিক ফ্লেভার কম্পাউন্ড (কর্কট রোগ ঘটাতে সক্ষম) ব্যবহার করা হয়েছে, যা প্রয়োজন হয় কৃত্রিম গন্ধের জন্য। এ ছাড়া মেশানো হয় নানা রাসায়নিক পদার্থ, যা স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, হার্টের অসুখ ও রক্তের সমস্যা ডেকে আনে।
রঙ মেশানোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও ভয়াবহ। ফুডগ্রেড (খাদ্যের জন্য উপযুক্ত) রঙ অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয় না। আর যদিও বা ব্যবহার হয় তখন ফুডগ্রেড রঙ প্রয়োজনের অতিরিক্ত মেশানো থাকে। সাধারণত ১০০ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) থেকে বেশি পরিমাণ লাগে এই ঝকঝকে লোভনীয় গুড়ের রঙ আনতে। সে কারণেই খাদ্যের জন্য উপযুক্ত রঙ হওয়া সত্ত্বেও সেটি ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়ায়। এই নলেন গুড়ের যে চকলেটের মতো রঙ হয়, সেটি আনার জন্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রঙ ব্যবহার করা হয়।
যে বিষাক্ত রাসায়নিক থাকে এই কৃত্রিম রঙ গুলিতে
আর্সেনিক— প্রজননজনিত সমস্যা, কিডনির ক্ষতি, মস্তিষ্কের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ ডেকে আনে।
ক্যাডমিয়াম— শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, ক্যানসারের ঝুঁকি, হাড়ের ক্ষয়, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
টেস্ট করে দেখে নিন ভালো না ভেজাল। এক টুকরো গুড় পানিতে ফেলে দিন। বিশুদ্ধ গুড় দ্রুত গলে যাবে, কিন্তু ভেজাল গুড়ে আলাদা স্তর দেখা যাবে। গুড় গরম করলে যদি তা থেকে ধোঁয়া বের হয় বা কালো পদার্থ বের হয়, তাহলে বুঝবেন এটি ভেজাল।
গুড়ের প্যাকেটের ওপর FSSAI সিল থাকা জরুরি।
বেশি চকচকে বা কম দামের গুড় এড়িয়ে চলুন।
ভেজাল গুড় চেনার সহজ উপায়
বর্ণ
বিশুদ্ধ গুড় সাধারণত গাঢ় বাদামি বা প্রাকৃতিক সোনালি রঙের হয়।
ভেজাল গুড় দেখতে উজ্জ্বল হলুদ বা লালচে হতে পারে। কারণ এতে কৃত্রিম রঙ মেশানো হয়।
শুধু নলেন গুড় নয়, পাটালিও এই সময় সবাই খান। খাঁটি গুড় আঙুল দিয়ে ভাঙা যায় অনায়াসে এবং দুই আঙুল দিয়ে ঘষলে সহজে গলে যায়। আখগুড় মেলানো থাকলে ইটের মতো শক্ত হয়ে যায়।
স্বাদ
ভালো গুড়ে থাকে প্রাকৃতিক মিষ্টতা। অতিরিক্ত মিষ্টি হবে না। চিনির শিরা মেশানো থাকলে মুখে দিলে বুঝবেন মিষ্টির গাঢ়ত্ব বেশি। খাঁটি নলেনের বিশেষত্ব হালকা মিষ্টি।
গন্ধ
বিশুদ্ধ গুড়ে থাকবে হালকা আখ বা খেজুরের সুগন্ধ।
সূত্র: যুগান্তর