পশু কুরবানির মাধ্যমেই মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়। এ সময়ে প্রায় সব বাড়িতেই মাংসের আধিক্য দেখা যায়। এ কারণে বছরের অন্যান্য দিনের তুলনায় কুরবানির ঈদে মাংস খাওয়া হয় বেশি এবং তা হয় সময় ও হিসাব ছাড়া। অনেক সময় মাত্রাতিরিক্ত মাংস খাওয়ার ফলে দেখা যায় শারীরিক অসুস্থতা। যেমন-বদহজম, পেট ফাঁপা, ডায়রিয়া, আমাশয়, পেটে ব্যথা, বমি ইত্যাদি। পেট ফাঁপার ফলে অনেক সময় মাথা ব্যথা ও অবসাদ দেখা দেয়।
যদিও গরু-খাসির মাংসের মধ্যে থাকে সব এমাইনো এসিড, লৌহ, ফসফরাস, ভিটামিন বি১ ও ভিটামিন বি২। এতসব পুষ্টি উপাদান থাকার পরও মাংস বেশি খাওয়া উচিত নয়। কারণ এতে হজমের ব্যাঘাত ঘটে।
দেখা যায় ঈদের দিনে সবজি একেবারেই খাওয়া হয় না। এই কারণে টকদই, লেবু, শসা, পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ দিয়ে সালাদ করে খেলে ভালো হয়। আবার বিভিন্ন ধরনের সবজি হালকা তেল মসলা দিয়ে রান্না করে অথবা চাইনিজ ভেজিটেবল করে খাওয়া যেতে পারে। সবজির মধ্যে কাঁচা পেঁপে থাকলে খুবই ভালো হয়। এতে মাংসের প্রোটিনের পাশাপাশি ভিটামিন ও খনিজ লবণের ঘাটতি হয় না। তেমনি কোষ্ঠকাঠিন্য থেকেও বাঁচা সম্ভব। বাড়িতে যারা বয়স্ক লোক আছেন তারা শক্ত মাংস খেতে না পারলে তাদের সুসিদ্ধ মাংস, শামিকাবাব, কিমা রান্না, কলিজা ও মগজ ভুনা করে দিতে পারেন। এতে তারা ঈদের আনন্দ ভালোভাবে উপভোগ করতে পারবেন।
রান্নার ফলে মাংসে নানারকম পরিবর্তন ঘটে। তাপে মাংসের প্রোটিন জমাট বাঁধে ও নরম হয়। তবে এতে যে কোলাজেন নামক প্রোটিন আছে, সেটা জমাট বাঁধে না। খুব বেশি তাপে মাংসের প্রোটিন কঠিন ও সংকুচিত হয়ে পড়ে। এই শক্ত মাংস হজম করা কষ্টকর। সব ধরনের মাংসই কোমল হয় যদি অল্প আঁচে বেশিক্ষণ ধরে রান্না করা হয়। এতে খাদ্যগুণের কোনো ঘাটতি হয় না।
গরু-খাসি অর্থাৎ রেডমিট শরীরের জন্য উপকারী হলেও এতে অনেক সময় বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। টিনিয়া সেলিয়াস নামক এক ধরনের পরজীবী রেডমিটে থাকে। যা দেহে বিশেষ ধরনের টিউবার কিউলোসিস (যক্ষ্মা) এর জন্ম দেয়। এই জাতীয় জীবাণু অন্ত্র, পাকস্থলী, যকৃত প্রভৃতি জায়গায় প্রবেশ করে আমাদের অসুস্থ করে তোলে। অর্ধসিদ্ধ মাংসই দেহে এ ধরনের রোগের বিস্তার ঘটায়। এ কারণে শিককাবাব ও বারবিকিউ খেতে গেলে সাবধান হওয়া প্রয়োজন। ঈদের দিনে অনেকেই এ ধরনের খাবার তৈরিতে উৎসাহ দেখান। বিশেষ করে বাড়ির ছেলেদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায়।
এই গরমের মধ্যে অনেকের মধ্যে পানি স্বল্পতা দেখা যায়। এই কারণে যারা মাংস কোটা-বাছা এবং গোছাবেন, যারা রান্না ঘরে কাজ করবেন তাদের উচিত কিছুক্ষণ পরপর পানি পান করা। এছাড়া খেতে পারেন ফলের রস, লেবু-পুদিনার শরবত, তোকমার শরবত, ঘোল, মাঠা ইত্যাদি।
কিছু কিছু অসুস্থতায় মাংস কম খাওয়া ভালো। যেমন-ওজন বেশি থাকলে, পেটের সমস্যা অর্থাৎ লিভারের সমস্যা থাকলে, কিডনি রোগ থাকলে। এছাড়া আর্থ্রাইটিস, রক্তে কলস্টেরল ও ট্রাইগ্লাইসেরাইড বেশি থাকলে, হৃদরোগ থাকলে মাংসের চর্বি, কলিজা, মগজ, পায়ার স্যুপ (নেহারি), ভুঁড়ি বাদ দেওয়া ভালো।
সুতরাং, ঈদের আনন্দ পুরোপুরি পেতে হলে মাত্রাজ্ঞান রেখে এবং সতর্কতার সঙ্গে জীবাণুমুক্ত মাংস খাওয়া উচিত। একেবারে বাদ না দিয়ে সীমিত পরিমাণে, সময় মেনে মাংস খেলে তেমন অসুবিধা হয় না। সুস্বাস্থ্যের জন্য পরিমিত আহারই উত্তম।
নিরাপদে কুরবানির কাজ সম্পন্ন করতে নিতে হবে বিশেষ স্বাস্থ্য সতর্কতা। যেমন-
কুরবানির কাজটি সম্পূর্ণ করতে অবশ্যই পরিষ্কার তিনস্তরের কাপড়ের মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস ও শুরুর আগে-পরে সাবান পানি বা জীবাণুনাশক লিকুইড ব্যবহার করতে হবে। তাহলে সংক্রমণের আশঙ্কা একদম কমে যাবে।
স্বস্তির কথা হচ্ছে মাংস থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে; কিন্তু যদি যে কোন অসুস্থ ব্যক্তি এসব কাজে যুক্ত থাকেন, তাহলে ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ছড়াতে পারে। তাই কুরবানির স্থানে বেশি লোকসমাগম করা যাবে না। অন্যবারের চেয়ে কম সংখ্যক সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ রাখুন কুরবানির কাজে।
কুরবানি শেষে কুসুম গরম পানি ও সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করুন ও গায়ের পোশাক পরিবর্তন করুন।
নির্দিষ্ট স্থানে কুরবানির পশু জবাই করতে হবে। এবং পর্যাপ্ত পানি ঢেলে রক্ত পরিষ্কার করা প্রয়োজন। পশু কুরবানির রক্ত গর্তে মাটি চাপা দিয়ে পরিবেশ স্বাস্থ্র্যকর রাখা যায়। এছাড়া যে স্থানে মাংস কাটা হবে সেখানে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে দিয়ে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
কুরবানির মাংস তিনভাগ করে এক ভাই অবশ্যই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিতরণ করুন। এ বছর ভিড়বাট্টা পরিহার করা উচিত।
প্রতিবারের মতো কুরবানির বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। কুরবানিরকৃত পশুর বর্জ্য দ্রুত অপসারণের জন্য সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভার পরিচ্ছন্ন কর্মীকে সহায়তা করতে হবে। সিটি কর্পোরেশনকে এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে পরিচ্ছন্নতার দিকে একটু বিশেষভাবে ত্বরিৎ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের দিকে নজর দিতে হবে।