সাধারণত বাঙালি হিন্দু বিবাহিত নারীরা স্বামীর মঙ্গলের জন্য হাতে শাঁখা পরে থাকেন। এর সঙ্গে তারা আরও পরেন নোয়া ও পলা।
শাঁখা পরা নিয়ে বেশ কিছু বিচিত্র গল্প আছে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মহাভারতের সময়কাল থেকে শাঁখার ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় ত্রিভুবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে শঙ্খাসুর নামের এক অসুরের তাণ্ডবে। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে স্বর্গের দেবতারা শরণাপন্ন হন বিষ্ণুর। বিষ্ণু এই অসুরকে বধ করে দেবতাদের রক্ষা করেন। তখন নারায়ণের কাছে স্বামীকে ফেরত পাওয়ার জন্য ধ্যান শুরু করেন শঙ্খাসুরের ধর্মপরায়ণ স্ত্রী তুলসী। নারায়ণ তুলসীর প্রার্থনায় সাড়া দিলেও শঙ্খাসুরকে ফিরিয়ে দিতে পারেন না। পরিবর্তে শঙ্খাসুরের প্রতীক হিসেবে তাঁরই হাড় দিয়ে তৈরি করেন শাঁখা এবং তুলে দেন তুলসীর হাতে। সেই থেকেই স্বামীর মঙ্গল কামনায় শাঁখা পরার চল শুরু হয় বিবাহিত নারীদের মধ্যে।
এখন শুধুমাত্র বিবাহিত নারীরা নয়, কম-বেশি অনেকেই সাদা শাঁখা এবং লাল রঙের পলা ফ্যাশানের অংশ হিসেবে পরতে দেখা যায়। শাঁখা তৈরি হয় শঙ্খ। এ শঙ্খ পাওয়া যায় শ্রীলঙ্কা ও চেন্নাইয়ের সমুদ্রতীরে। একসময় মাদ্রাজ থেকে আমদানি করা হলেও বর্তমানে শ্রীলঙ্কা থেকে আমদানি করে এ দেশে শঙ্খের চাহিদা মেটানো হয়। হাতের শাঁখার মধ্যেও বিভিন্ন নামের শাঁখা রয়েছে। এর মধ্যেসাতকানা, পাঁচদানা, তিনদানা, বাচ্চাদার, সাদাবালা, আউলাকেশী উল্লেখযোগ্য। সৌখিনদের জন্য রয়েছে সোনা বাঁধাই শাঁখা।
শাঁখা যেভাবে বানায়
প্রথমে শঙ্খগুলোর মুখ ভেঙে দিতে হয় হাতুড়ির ঘায়ে। ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয়। এর পরের ধাপে শঙ্খ কাটতে হয়। বিশেষ ধরনের করাত দিয়ে শঙ্খকে গোলাকার করে কেটে বিভিন্ন আকারের বলয় তৈরি করা হয়। এরপর সেটিকে শিল দিয়ে ঘষে মসৃণ করা হয় এবং বিভিন্ন নকশা করা হয়। প্রতিটি শাঁখার জোড়া অংশ নিখুঁতভাবে লাগিয়ে তাতে ফুল, লতা, মাছ, পাখি, আলপনাসহ নকশা তোলা হয়। মোটা শঙ্খ থেকে দুটি, অর্থাৎ এক জোড়া শাঁখা তৈরি হয়। সরু শঙ্খ থেকে চারটি শাঁখা পাওয়া যায়।
ফ্যাশনে শাঁখা
হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়েতে শাঁখা ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে দিনবদলের সঙ্গে সঙ্গে বদল এসেছে অনেক প্রচলিত নিয়ম-রীতি। এখন আর বিবাহিত নারীদের অনেকে আগের মতো প্রতিদিন শাঁখা-পলা পরেন না। কোন অনুষ্ঠানে বা বাড়ির পূজার সময় পরতে দেখা যায়। অন্যদিকে অনেকেই আবার এই শাঁখা-পলাকে ফ্যাশনে পরিণত করেছেন। আগে নারীরা দুই হাতে দুটি শাঁখা পরতেন। এখন ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে এ ধারা। এক হাতে একাধিক শাঁখা এবং আরেক হাত সম্পূর্ণ খালি রাখার চলও চোখে পড়ছে আজকাল। একটা সময় সরু শাঁখার চল ছিল। বর্তমানে শুরু হয়েছে মোটা শাঁখার ফ্যাশন। এ ধরনের শাঁখা পরা যায় পলার সঙ্গে, আবার পলা ছাড়াই পরা যায়। সঙ্গে থাকতে পারে অন্য কোনো বালা বা কয়েক গাছা সরু চুড়ি। এছাড়াও দেখা যায় বাজারে কিছু শাঁখা শুধুই সাদা প্লাস্টিকের ওপর নকশা করা, আবার কিছু সোনালি প্লাস্টিক বা হালকা কোনো ধাতু দিয়ে সাজানো।
কোথায় পাওয়া যাবে
ঢাকার শাঁখারীবাজার, স্বামীবাগ, রমনা কালীমন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ বিভিন্ন মন্দিরের সামনের স্টেশনারি দোকানগুলোয় শঙ্খের তৈরি শাঁখা পাওয়া যায়। প্লাস্টিক বা অন্যান্য উপাদানের তৈরি শাঁখা মিলবে ঢাকার গাউছিয়া, চাঁদনী চক, দেশের সব ছোট-বড় শপিং মল, মার্কেট, স্টেশনারি ও গয়নার দোকানে।
দরদাম
সাধারণ নকশার শাঁখার দাম তুলনামূলকভাবে কম। বড় আকারের একটি শঙ্খ থেকে দুই বা তিন জোড়া শাঁখা তৈরি হয়। এসব শাঁখা প্রতি জোড়া ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে মূলত নকশার ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয় শাঁখার দাম। শাঁখার দোকান থেকে বিশেষ ধরনের ঘর করে কাটা নকশাবিহীন শাঁখা কিনে স্বর্ণকারের কাছ থেকে সোনা দিয়ে বাঁধাই করতে দেন অনেকেই। ৪ হাজার থেকে শুরু করে দাম ওঠে ১০ হাজার পর্যন্ত। সে ক্ষেত্রে সোনার পরিমাণ, নকশা ও কারিগরের মজুরির ওপর নির্ভর করবে এক জোড়া শাঁখার খরচ। এ ছাড়া পুঁতি বসানো শাঁখাও পাওয়া যায় বাজারে। এগুলোর দাম ৬০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা। তবে প্লাস্টিকের তৈরি শাখার দাম শুরু হয় ১২০ টাকা থেকে।
সূত্র: ইত্তেফাক