মানুষ এখন এক অস্বাভাবিক পৃথিবীর বাসিন্দা। বিশ্বকে এ বছর সন্ত্রস্ত ও বিপর্যন্ত করে চলেছে এক ভয়ংকর ভাইরাস করোনা। ১৭ লাখের বেশি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এই মহামারি, আক্রান্ত করেছে প্রায় আট কোটি মানুষকে। ধস নামিয়েছে অর্থনীতির। বছর শুরুর মাত্র তিন দিন আগে চীনের উহান থেকে শুরু হয়ে দ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে এই নতুন করোনাভাইরাস। বিশেষজ্ঞরা বলছে, আগের কোনো কোনো মহামারি করোনার চেয়ে বেশি মানুষ মারলেও তা সীমাবদ্ধ ছিল কিছু দেশের মধ্যে। কখনোই বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েনি এবারের মতো। একে বাগে আনতে মানবজাতির সম্মিলিত চেষ্টাও চলছে নজিরবিহীনভাবে।
রোগতত্ত্ববিদ ড. মুশতাক হোসেনের ভাষায়, ‘একটি বছর আমাদের নজিরবিহীন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে। প্রতিদিনই আমাদের নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে, নতুন করে জানতে হচ্ছে অনেক কিছু। এক বছরের মুখে এসেও এখনো অনেক কিছুই আমাদের জানা নেই। তবে আমরা আশা করি, নতুন বছরে আমরা টিকা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার সব কিছু মেনে চলে করোনাকে জয় করতে পারব।’
গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর প্রথম বিশ্বে ভাইরাসটি মানবদেহে শনাক্ত হলেও বাংলাদেশে প্রথম শনাক্ত হয় ৭০ দিনের মাথায় চলতি বছরের ৮ মার্চ। তবে ওই ২৯ ডিসেম্বর চীনের উহান থেকে খবর ছড়ানোর পর বছরের প্রথম থেকেই অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও সৃষ্টি হয় উদ্বেগন্ডউৎকণ্ঠান্ডকৌতূহল। পর্যায়ক্রমে দেশের বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত নড়াচড়া শুরু হয়। প্রস্তুতি ও পরিকল্পনাতোড়ে আটকে যায় প্রথমত স্বাস্থ্য খাত এবং পর্যায়ক্রমে পুরো সরকারব্যবস্থা। ৮ মার্চের পর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম মৃত্যু ঘটে করোনাভাইরাসের কারণে। এর পর থেকেই শুরু হয় ভীতিকর পরিস্থিতি, পাল্টে যায় জীবনযাত্রা; অর্থন্ডবাণিজ্য থেকে শুরু করে মানুষের সামাজিকন্ডসাংস্কৃতিক কিংবা পারিবারিক সব পরিবেশই যেন থমকে যায়। বন্ধ হয়ে যায় আকাশপথ, সড়কপথ, নৌপথসহ সব যোগাযোগ। ‘লকডাউনে’ বন্দি হয়ে পড়ে জীবন।
এর মধ্যেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা। পরীক্ষা না করাতে পেরে মানুষের ছোটাছুটি, চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ঘোরাঘুরি; রোগী রাখতে চায় না কোনো হাসপাতাল, হাসপাতালে চিকিৎসক নেই, স্বজনদের নিয়ে মানুষের হাহাকার, করোনায় মৃতের লাশ ফেলে রেখে স্বজনদের পালিয়ে যাওয়া, আক্রান্ত হওয়ার খবর পেয়ে প্রতিবেশীদের হয়রানি, ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেন বাড়িওয়ালা, আক্রান্ত রোগীর বাসাবাড়ি লাল পতাকা দিয়ে চিহ্নিত করা, পুলিশের পাহারা এ রকম আরো অনেক রকম অমানবিক ঘটনায় গত এক বছর পার হচ্ছে এই দেশে।
অন্যান্য দেশেও ঘটেছে এমন ঘটনা। ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে মানুষ; ভয়কে জয় করে করোনার সঙ্গে বসবাসের সাহস নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঘর ছেড়ে, উঠে যায় লকডাউন। সব কিছু অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে আগের মতোই। তবে সুরক্ষার বাণী হয়ে টিকে আছে মাস্ক ব্যবহার, বারবার হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার সতর্কতা। সরকার রীতিমতো আদেশ জারি করে বাধ্যতামূলক করেছে এই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা।
এর মাঝেই করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্য খাতে সরকারি কেনাকাটা, প্রাইভেট সেক্টরে ভুয়া পরীক্ষা, ভুয়া চিকিৎসা, ভুয়া চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান, তাদের কারো কারো সঙ্গে সরকারের চুক্তি, রোগীদের সঙ্গে প্রতারণা, চিকিৎসার নামে বাণিজ্য বহু রকমের দুর্নীতি অনিয়ম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, বদলি হন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব। অদলন্ডবদল হয় মন্ত্রণালয় অধিদপ্তরের বহু কর্মকর্তার চেয়ার। অনেক কিছু ছাপিয়ে বড় খবর হয়ে ওঠে রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজির মাধ্যমে নজিরবিহীন প্রতারণার প্রধান দুই চরিত্র মোহাম্মদ শাহেদ ও ডাক্তার সাবরিনা। এর বাইরে নকল মাস্ক ও পিপিই সরবরাহের মতো ঘটনা ঘটে এই করোনাকাল ঘিরে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য খাতের বাইরে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে সরকারের সহায়তাস্বরূপ ত্রাণ নিয়ে নানা কেলেঙ্কারিন্ডঅনিয়ম, জেলন্ডজরিমানাও ছিল আলোচিত ঘটনা। আরেক দিকে করোনা চিকিৎসায় ব্যবহার করা ওষুধ, সুরক্ষাসামগ্রী হিসেবে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, পিপিই নিয়ে চলে বেশুমার বাণিজ্য। নকল ও ভেজাল উপকরণ ছড়িয়ে পড়ে বাজারে। মানুষের বিপদকে জিম্মি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা উঠে পড়ে লেগে যায় অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিতে। বেসরকারি হাসপাতালে বাড়িয়ে দেওয়া হয় চিকিৎসা খরচ। বিশেষ করে অক্সিজেন এবং আইসিইউ বাণিজ্য বেড়ে যায়। আইনন্ডশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অভিযানে নামতে হয় এমন পরিস্থিতি বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে।
পাশাপাশি করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আগের তুলনায় কিছু উন্নতি ঘটলেও এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল অবস্থায় আসেনি। হাসপাতালগুলোতে সাধারণ বেড খালি থাকলেও আইসিইউ বেড সরকারি হাসপাতালগুলোতে এখনো দুষ্প্রাপ্য। প্রথম দিকে পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপকমাত্রায় বিশৃঙ্খলা থাকলেও পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তা অনেকটা কমেছে। শুরুর দিকে কিট সংকট থাকলেও এখন তা সহনীয় পর্যায়ে চলে এসেছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত অ্যান্টিবডি কিট অনুমোদন নিয়ে নানা ধরনের টালবাহানার পর সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়। প্রথম দিকে শুধু একটি মাত্র ল্যাবে টেস্ট হলেও এখন তার পরিধি বেড়েছে। হাসপাতালের সংখ্যা বেড়েছে। ওষুধ অনেকটা সহজলভ্য হয়েছে।
তবে ইউরোপন্ডআমেরিকা কিংবা ভারতে যেভাবে সংক্রমণ ছড়িয়েছে এবং যেভাবে আক্রান্তদের মৃত্যু ঘটেছে, বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হয়েও ততটা শোচনীয় অবস্থায় পড়েনি, অন্ততপক্ষে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে।
যদিও এখন পর্যন্ত দেশের সঠিক আক্রান্ত কত লাখ মানুষ তার কোনো হিসাব নেই কারো কাছে। নেই ভালো কোনো গবেষণা। নামমাত্র একটি গবেষণা হলেও তার ফলাফল নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ওষুধের গবেষণা নিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছেন বাংলাদেশ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এক অধ্যাপক ডা. তারেক আলম তাঁর ‘আইভারমেকটিন’ নিয়ে।
পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী করোনার টিকা নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরুর পর থেকেই বাংলাদেশও তাল মেলানোর চেষ্টা করছে তার সঙ্গে। তবে ট্রায়াল হয় হয় করেও এখন পর্যন্ত কোনো ট্রায়াল শুরু হয়নি দেশে। দেশীয় কম্পানি গ্লোব ফার্মাসিটিক্যালস নিজস্ব একটি টিকা উৎপাদনের পথ দেখালেও তা থেমে আছে। যদিও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থায় টিকা উদ্ভাবনের আবেদনকারীর তালিকায় তারা বাংলাদেশের নাম তুলে রেখেছে। বেসরকারি সংস্থা আইসিডিডিআরবি চীনের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করলেও তা ভেস্তে গেছে। নতুন আরো একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে টিকার ক্ষেত্রে সরকারি ব্যবস্থাপনা এগিয়ে চলছে অনেক দিন ধরেই। অক্সফোর্ড উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদন শুরু হলে তা পাওয়ার জন্য সরকার চুক্তি করেছে। সেরাম থেকে টিকা বাংলাদেশে আনার জন্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে অংশ নিয়েছে দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মা লিমিটেড। অপেক্ষা এই ভ্যাকসিনের অনুমতি পাওয়া এবং দেশে আসা।
শুরু থেকে করোনাভাইরাসের গতিন্ডপ্রকৃতি নিয়ে দেশের বিজ্ঞানীদের বিভক্তিমূলক মতামত মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে অহরহ। এর মধ্যে দেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, জুনন্ডজুলাই মাসেই দেশে করোনা সংক্রমণের পিক ছিল।