দ্রুত ফসল উৎপাদনের জন্য ইউরিয়া বহুল ব্যবহৃত রাসায়নিক সার, গাছের সবুজ অংশের বৃদ্ধিতে এর ভূমিকা প্রধান। সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হয় ধান, গম, ভুট্টা চাষের জমিতে। পৃথিবীতে যত ইউরিয়া উৎপাদন হয় তার প্রায় ৯০ শতাংশ ব্যবহার কৃষিক্ষেত্রে।
কারখানাটি দেশের কৃষি উৎপাদন, কৃষি অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্যে ইতিবাচক অবদান রাখবে। মাটিতে (ইউরিয়া) নাইট্রোজেন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হলে ক্লোরোফিল সংশ্লেষণের হার কমে যায়। ফলে ফসলের স্বাভাবিক সবুজ বর্ণ হারিয়ে ফেলে। পাতার আকার ছোট হয় এবং শাখা প্রশাখার বৃদ্ধি হ্রাস পায়, ফলে গাছ খর্বাকার হয় এবং ফলনে বিপর্যয় ঘটে। তাই কৃষিতে ইউরিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম।
নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় নবনির্মিত ‘ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা’ নামের এই কারখানাটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই কারখানায় বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদিত হবে।
উন্নত দেশ যেমন ইউরোপ, আমেরিকা ও জাপান থেকে যন্ত্রপাতি এনে এখানে কারখানা স্থাপন করা হয়েছে। কারখানাটি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর, শক্তি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। জাপানের এম এইচ আই ও চায়না সিসি সেভেন কোম্পানি কারখানাটি নির্মাণ করেন। এটি চালু হলে শিল্পখাতে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। দেশের বাইরে থেকে সার আমদানি হ্রাস পাবে ফলে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। মানুষের নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
এই কারখানার বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয়েছে ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন, শক্তি সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব গ্রানুলার ইউরিয়া উৎপাদনে সক্ষম এই সার কারখানা দেশে ইউরিয়া সারের স্বল্পতা ও ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশে কম-বেশি প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন সারের চাহিদা রয়েছে। ৬ থেকে ৭ লাখ মেট্রিক টন সার আমদানি করতে হয় প্রতি বছর।
দেশের অভ্যন্তরীণ ইউরিয়া সারের চাহিদা মেটানো এবং সুলভ মূল্যে কৃষকদের কাছে সার সরবরাহ নিশ্চিতে নরসিংদীর পলাশে স্থাপিত হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ পরিবেশবান্ধব ‘ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা’। এটি চালু হলে দৈনিক ২৮০০ মেট্রিক টন করে বছরে গড়ে ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার উৎপাদন সম্ভব হবে। ফলে সারের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সারের জোগান বাড়ানো সম্ভব।
দেশের ইউরিয়া সারের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে বার্ষিক ৩ লাখ ৪০ হাজার এবং ১৯৮৫ সালে ৯৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন যথাক্রমে ঘোড়াশাল এবং পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপিত হয়।
কারখানা দুটি পুরোনো হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস এবং ডাউন টাইম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারখানা দুটির জায়গায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন, শক্তিসাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি সার কারখানা নির্মাণের নির্দেশনা দেন।
সেই প্রেক্ষিতে বার্ষিক ৯ লাখ ২৪ হাজার মেট্রিক টন ক্ষমতাসম্পন্ন নতুন গ্রানুলার ইউরিয়া সার কারখানা স্থাপনের লক্ষ্যে ‘ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্প’ শীর্ষক প্রকল্পটি নেওয়া হয়। জাপানি প্রতিষ্ঠান এমএইচআই-এর কাছে কারখানাটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজারের প্রকল্প এর কারখানাটি যখন পুরোপুরি উৎপাদনে যাবে, তখন ৯৬৮ জন লোকের স্থায়ী কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া ১৫০০ থেকে ২০০০ লোক কারখানায় বিভিন্নভাবে প্রতিদিন কাজ করবে।
সার কাখানায় লোডিং-আনলোডিং, সার বস্তাবন্দি করা, প্যাক করা, ট্রাকে ট্রেনে উঠানো এসব জায়গায় কমপক্ষে দুই হাজার লোক কাজ করবে। এছাড়া এই কারখানায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ত্রিশ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে। জাপানিজ কনসালটেন্টদের মাধ্যমে কারখানার প্রত্যেকটা কর্মকর্তা, অপারেটরদের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে, দেশে এবং বিদেশে।
বর্তমানে দেশের জনবল দিয়ে অপারেটিং সিস্টেম চালানো হচ্ছে, বিদেশিরা সাথে থাকছে। এতে করে দেশের কর্মকর্তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ছে। কোনোরকম ভুল হলে তারা তা শুধরে দিচ্ছে, দেখিয়ে দিচ্ছে। হাতে-কলমে ট্রেনিং দিচ্ছে। কারখানার অফিসার, অপারেটররা সক্ষম, তারা তাদের সামর্থ্য দেখাচ্ছে, তাদের পর্যাপ্ত ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। কারখানাটি এখন ট্রায়াল রানে আছে, কোনোরকম সমস্যা হচ্ছে কি না সবকিছুই নজরদারিতে রাখা হচ্ছে। ট্রায়ালও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
৪৩৬ একর জায়গার মধ্যে ১১০ একর জায়গা নিয়ে স্থাপিত কারখানাটি নির্মাণে ব্যয় হবে ১৫ লাখ ৫২০ কোটি টাকা। দেশের মোট সারের সিংহভাগ পূরণের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে উৎপাদনে যেতে আর অপেক্ষা অল্প সময়ের।
এটি চালু হলে দেশের অন্যান্য কারখানায় চাপ কমার পাশাপাশি বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভরতা কমবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ সার কারখানা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিরাট ভূমিকা রাখবে।
এই কারখানাটি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করবে। পাশাপাশি সার আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাবে একই সঙ্গে কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা বৃদ্ধি পাবে। দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
লেখক: কৃষি ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ।