টেকনাফের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ক্রসফায়ার বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত দুটি সিন্ডিকেটের সন্ধান পাওয়া গেছে।
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, ইয়াবার তকমা দিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতে ও দুর্বলদের ক্রসফায়ার দিতে থানায় নিজের ঘনিষ্ঠ একটি সিন্ডিকেট এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালীদের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন প্রদীপ।
তার জন্য দেনদরবার করতেন টেকনাফের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী। তাঁদের মধ্যে রয়েছে টেকনাফ পৌরসভার বাসিন্দা ও সাবেক এমপি আব্দুর বদির ফুফা হায়দার আলী, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আবু সৈয়দ এবং পৌর এলাকার জুয়েলারি ব্যবসায়ী সজল। তাঁরা তিনজনই সাবেক এমপি বদির আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজন।
কোনো ব্যক্তিকে আটক করলে ওই তিন ব্যক্তির যেকোনো একজন যোগাযোগ করতেন আটক ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে। তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন করে আটক ব্যক্তিকে পাঠানো হতো জেলে। তাঁরা বড় বড় ইয়াবা কারবারিকেও টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতেন। এঁদের মধ্যে হায়দার আলীর এক ছেলে প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করেছেন।
বদির ব্যবসায়িক অংশীদার আবু সৈয়দ ও তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধেও রয়েছে ইয়াবা কারবারের অভিযোগ। জানতে চাইলে গতকাল অভিযোগ অস্বীকার করে আবু সৈয়দ বলেন, ‘ভালো লোকজন ধরলে আমি যাইতাম। তবে কোনো কারবার করি নাই।’
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, থানায় ওসি প্রদীপের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বহাল আছেন এএসআই ফকরুল জামান, এসআই জামসেদ, এসআই সুজিত, কনস্টেবল নাজমুল (ওসির বডিগার্ড), এসআই মশিউর রহমান, এএসআই আমির হোসেন, এএসআই মিসকাত উদ্দিন, কনস্টেবল রুবেল দাশ (‘ক্রসফায়ারে’ সবচেয়ে বেশি গুলি ছুড়েছেন), কনস্টেবল মো. মহিউদ্দিন খান, কনস্টেবল আবদুল আজিজ, এসআই দীপক বিশ্বাস, এএসআই সঞ্জিব দত্ত, কনস্টেবল বাহার উদ্দিন, এএসআই মিঠুন চক্রবর্তী (ওসি প্রদীপের ভাগ্নে), কনস্টেবল সাগর দেব, এএসআই কাজী সাইফ মাহমুদ এবং টেকনাফ পৌর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল হোসাইন। তাঁরা ক্রসফায়ারের নামে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
টেকনাফের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, ‘ওসি প্রদীপের সহযোগীরা নিরপরাধ লোকদের মাদক কারবারি বানিয়েছে। তারা অভিযানে গেলে সঙ্গে থাকত একটি করে নোয়া গাড়ি। এসব গাড়ি নিয়ে তারা টেকনাফের আনাচকানাচ চষে বেড়াত এবং লোকজনকে আটক করে রাতে থানায় নিয়ে যেত। কেউ দাবি করা টাকা না দিলে তার ভাগ্যে জুটত বুলেট।’
পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, আত্মীয়-স্বজনের নামে কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে জমি কিনে বাড়ি করেছেন প্রদীপ। রয়েছে গাড়ি। তাঁর স্ত্রী চুমকীর নামে চট্টগ্রাম মহানগরে ছয়তলা বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, একাধিক গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদের তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে তাঁদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম কার্যালয়। একাধিক সূত্র দাবি করেছে, ভারতের আসামের রাজধানী গুয়াহাটি শহরের পল্টন স্টেশনের পাশে প্রদীপের দুটি অভিজাত বাড়ি রয়েছে।
১৯৯৫ সালে জোট সরকারের আমলে কক্সবাজারের শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ কর্মী বলে পরিচিত প্রদীপ পুলিশে উপপরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করার সময় ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন তিনি। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের আস্থাভাজন বনে যান প্রদীপ।
২০১৮ সালের মহেশখালী থানার ওসি থাকা অবস্থায় নিজেকে আওয়ামী লীগের মতাদর্শী প্রমাণে উপজেলা কমিটির সভায় নিয়মিত হাজির হতেন প্রদীপ। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ছিলেন বিব্রত। তবে ক্ষমতাধর প্রদীপের ভয়ে কেউ আপত্তি জানাতে সাহস পাননি।
সূত্র- কালের কন্ঠ