স্বাধীনতার আগে ও পরে স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগুলো ছিল মূলতঃ শহরকেন্দ্রিক। অথচ সে সময় ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুই সর্বপ্রথম স্বাস্থ্যসেবাকে তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে মাত্র তিন বছরেই তিনি প্রতিটি থানায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। চালু করেছিলেন ১০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতাল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর সেই তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উল্লেখযোগ্যভাবে গুরুত্ব পায়নি।
দীর্ঘ ২১ বছর পরে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরপরই তিনি বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন “সবার জন্য স্বাস্থ্য সেবা” বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন এবং “কমিউনিটি ক্লিনিক” স্থাপনের অভিনব ধারনা প্রবর্তন করেন। চিকিৎসা সেবাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন। প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে সর্বমোট ১৪ হাজার ৪৯০টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। ফলশ্রুতিতে, ২০০০ সালের ২৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার গিমাডাঙ্গা গ্রামে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক উদ্বোধন এর মধ্য দিয়ে দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা শুরু হয়। ২০০১ সালের মধ্যেই ১০ হাজার ৭২৩টি অবকাঠামো নির্মাণসহ প্রায় ৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম চালু করা হয়। এর ফলে চিকিৎসাসেবা প্রন্তিক জনগণের কাছে পৌঁছাতে শুরু করে।
কিন্তু ২০০১ পরবর্তী বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এসেই রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে জনগণের জন্য কল্যাণকর এই সফল স্বাস্থ্যসেবা কমিউনিটি ক্লিনিক এর কার্যক্রমটি বন্ধ করে দেয়। পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে ক্লিনিকগুলো। নষ্ট হয়ে যায় অনেক ভবন। ২০০১-২০০৮ সাল পর্যন্ত ক্লিনিকগুলো বন্ধ থাকার ফলে দেশের তৃণমূল মানুষ আবারও চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেওয়ার পর পুনরায় কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম নবোদ্যমে চালু হয়। সেই পরিত্যক্ত ও ব্যবহার অযোগ্য ভবনগুলো সংস্কার এবং নতুন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। দ্রুত বাড়তে থাকে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা। বর্তমানে ১৪ হাজার ২০০টি ক্লিনিক চালু রয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে ১৪ হাজার ৮৯০টি ক্লিনিকের নির্মাণ কাজ শেষ হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থাকে আইনি কাঠামোয় ঢেলে সাজাতে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে ২০১৮ সালে “কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট-২০১৮” নামে আইন প্রণীত হয়। ট্রাস্টি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে একই বছর উপদেষ্টা পরিষদের বিধান রেখে ১৬ সদস্য বিশিষ্ট বোর্ড গঠিত হয়। সভাপতি হিসেবে যার নেতৃত্বে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারের এ মহতি উদ্যোগে দেশের অসহায় দুস্থ মানুষ পুনরায় সহজে ও বিনা পয়সায় হাতের নাগালে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে।
২০ থেকে ৩০ মিনিট হাঁটার দূরত্বে বাড়ির কাছেই সহজ ও বিনামূল্যে সেবা পাওয়ার কারণে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো গ্রামের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং পারিবারিক হাসপাতাল হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিক হতে ৭৫.৭০ কোটির অধিক ভিজিটের মাধ্যমে তৃনমূল জনগন সেবা গ্রহন করেছে। শুধুমাত্র গত জুলাই ২০২১ থেকে জুন ২০২২ পর্যন্ত ক্লিনিকগুলোতে মোট ভিজিট হয়েছে প্রায় সাড়ে সাত কোটিরও বেশি। ১০ কোটিরও বেশি মানুষ পেয়েছেন বিনা মূল্যের এই স্বাস্থ্যসেবা। বর্তমানে দৈনিক প্রতিটি ক্লিনিকে ৭০-৮০ জনেরও বেশি মানুষ ভিজিট করেন। গড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষ সারাদেশে প্রতিদিন কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছে। মাসে দেড় কোটি এবং বছরে প্রায় ১৮ কোটি মানুষ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা নিচ্ছে, যার ৮০ শতাংশ নারী ও শিশু।
শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয়, কর্মক্ষেত্র তৈরিতে এ কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। বর্তমানে, প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে সিএইচসিপিদের সঙ্গে সপ্তাহে তিন দিন সেবা দিয়ে থাকেন একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী ও একজন স্বাস্থ্য সহকারী। সারাদেশের ১৪ হাজার ২২৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত ১৩ হাজার ৯০০ জন সিএইচসিপি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিচ্ছেন। কর্মরত সিএইচসিপিদের মধ্যে ৫৪ শতাংশ নারী, যা নারীর ক্ষমতায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচক্ষনতা ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গির বাস্তব প্রমাণ মিলেছে এবারের প্রাণঘাতী করোনা মহামারীকালে এবং দুর্যোগকালীন ঐ সময়ে অনন্য ভূমিকা রেখেছে এই কমিউনিটি ক্লিনিক। বিশ্বের বহু দেশ যেখানে অপ্রতুল ভ্যাক্সিন ও সুব্যবস্থাপনার অভাবে যথাসময়ে সবার কাছে ভ্যাক্সিন পৌঁছাতে পারেনি, বাংলাদেশ সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে এই সেবা যথাসময়ে পৌঁছে দিতে পেরেছে। সারাদেশে এই কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে পৌনে ৩ কোটিরও বেশি ভ্যাক্সিন দেওয়া হয়েছে। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠির চিকিৎসাসেবায় নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে যাচ্ছে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো, যা বদলে দিয়েছে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবার সামগ্রিক চিত্র। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশ সফরের সময় গ্রামে গিয়ে কমিউনিটি ক্লিনিক ঘুরে দেখেছিলেন এবং এই উদ্যোগকে ‘স্বাস্থ্য খাতে’ বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন। এ কথা সর্বাংশে সত্য যে, এই কমিউনিটি ক্লিনিক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বকীয় উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল যা আজ বিশ^নন্দিত। দেশ-বিদেশের এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই অভিনব ধারণা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসাবে আজ প্রমাণিত। এর ফলে দেশের তৃনমূল ও সর্বিক স্বাস্থ্য সেবার বিভিন্ন উন্নতি সূচকে ভারত, পাকিস্তান, নেপালসহ আরও অনেক দেশের তুলনায় এগিয়ে। এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আগামীর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণসহ সত্যিকার ভাবেই একটি স্বাস্থ্যকর জাতি গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
সম্প্রতি, “কমিউনিটি ভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা: সার্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অর্জনের লক্ষ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি” শিরোনামের ঐতিহাসিক রেজুলেশনটি জাতিসংঘে প্রথমবারের মতো সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহীত হয়। কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন স্বরূপ জাতিসংঘের ৭০টি সদস্য রাষ্ট্র এই রেজুলেশনটি কো-স্পন্সর করে এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলো এই ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী এই উদ্যোগকে ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে “দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ” হিসেবে আখ্যায়িত করে। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেজুলেশনটির সফল বাস্তবায়ন ও কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক: প্রক্টর, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।