মিরপুর ৬ নম্বর কাঁচাবাজারের বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। যে কটি দোকান খোলা, সেখানেও সব পণ্যের দাম চড়া। চাল-ডাল-শাক-সবজি-মাছ, সবকিছুর দাম এক সপ্তাহ ধরেই বাড়ছিল। গত এক দিনে তা বেড়ে অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ক্রেতাদের অনেককে মাছ-সবজির দাম শুনে শুধু শাক ও আলু কিনে বাড়ি ফিরতে দেখা গেল।
বাজার থেকে ৬ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতেই মনে হলো অন্য কোনো শহরে দাঁড়িয়ে আছি। চিরচেনা সেই যানজট ও ফুটপাতে ব্যস্ত মানুষের ছুটে চলা একদম নেই। ৬ নম্বর বাসস্ট্যান্ড থেকে ১০ নম্বর গোলচক্করের দিকে কিছুক্ষণ পরপর গুটিকয়েক বাস-প্রাইভেট কার সাঁ সাঁ করে চলছে। গলিগুলোতে যাত্রীদের আশায় হাতে গোনা কয়েকটি রিকশা; চালক হাঁকডাক দিচ্ছেন যাত্রীর আশায়। কিন্তু সাতসকালে সড়কগুলো ফাঁকা ময়দানে পরিণত হয়েছে। সড়কের দুই পাশে ছিন্নমূল মানুষগুলো হঠাৎ যেন ভোজবাজির মতো উধাও। কোথায় গেল তারা? নিজ গ্রামে?
রিকশায় উঠতেই চালক মোখলেস ফ্যাকাশে মুখে তাকিয়ে বললেন, ‘স্যার, দুই দিন ধইরা চালের টাকাই উঠতাছে না। সব তো বন্ধ হইয়া গেছে। আজকা আপনেই ফাস্ট প্যাসেঞ্জার। ঘরে চারজন খাওয়ার মুখ, দেশের বাড়িতেও টাকা দিতে হইতো। এখন সবাইরে নিয়া গ্রামে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই।’
রাজধানীর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুল পরিমাণে মানুষ করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় প্রায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ফুটপাতের হকার, পরিবহনশ্রমিক ও দোকান কর্মচারী সবার একই অবস্থা। মাসের শেষে এসে এই সংকট শুরু হয়েছে। একদিকে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে, অন্যদিকে সচ্ছল লোকজন বাসায় খাদ্য মজুত করছেন। নিম্নবিত্ত বেশির ভাগ মানুষ এখনো বেতন পাননি। ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতের মানুষের আয় কমে গেছে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক কৃষিসচিব এ এম এম শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের এখন পর্যন্ত করোনা পরিস্থিতির কারণে খাদ্য সহায়তার পরিকল্পনাটি ত্রাণকেন্দ্রিক। সাধারণ অন্য আট-দশটি দুর্যোগের সময় যেভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়, সেভাবে তারা খাদ্য সহায়তা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। কিন্তু এভাবে করলে অনেক মানুষ বড় ধরনের খাদ্যসংকটে পড়বে। তিনি বলেন, শিল্প খাতের শ্রমিকদের জন্য বিশেষ তহবিল তৈরি করে এবং দরিদ্রদের একটি খাদ্য প্যাকেজের আওতায় আনতে হবে। আর পুরো পরিস্থিতি কীভাবে সামলানো যায়, তা নিয়ে বিভিন্ন স্বাস্থ্য গোষ্ঠীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিকল্পনা করতে হবে।
করোনা সংক্রমণের এই সময়ে দেশের দরিদ্র মানুষেরা সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন। অতি দ্রুত দেশের এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া শুরু করা উচিত বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। দেশে সরকারি ও বেসরকারি গুদামগুলোয় পর্যাপ্ত খাদ্য মজুত থাকার কথা উল্লেখ করে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দ্রুত খাদ্য সহায়তা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার কথা বলছেন তাঁরা। বিশেষ করে যেসব এলাকা করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন করা হয়েছে, সেখানে শুধু চাল ও আটা নয়, অন্যান্য খাদ্যপণ্য এবং ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দেশের প্রতিটি জেলায় পর্যাপ্ত চাল ও অর্থ বরাদ্দ দিয়েছি। যেখানে যতটুকু সহায়তা দরকার সেখান থেকে তা বণ্টন করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ওই তালিকা জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে চূড়ান্ত হতে হবে। নয়তো দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হতে পারে। প্রয়োজন হলে আরও সহায়তা আমরা দেব। তবে আপাতত রেশন চালু করার পরিকল্পনা সরকারের নেই।’
কোন দেশ কী করছে
যাতে খাদ্যসংকট দেখা না দেয়, সে জন্য বিশ্বের অনেক দেশেই নাগরিকদের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়া শুরু করেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে। রাজ্যটির মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাড়ে সাত কোটি রাজ্যবাসীকে ছয় মাস বিনা মূল্যে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। কেরালা বিনা মূল্যে রেশন দিচ্ছে। অন্য রাজ্যগুলোও একই পথে হাঁটা শুরু করেছে। এর আগে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াও একই সুবিধা দিয়েছিল তাদের নাগরিকদের।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য ৮ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বিশেষ প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। ওই বিশেষ প্যাকেজের মধ্যে ১০০ কোটি ডলার খাদ্য কর্মসূচিও থাকছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই খাদ্য সহায়তা চলবে বলে দেশটির সরকার।
এ ক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলো আরও এগিয়ে। তারা করোনার কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের খাদ্য সহায়তা তো দিচ্ছে। পাশাপাশি আরও অনেক কিছু দিচ্ছে। ফ্রান্স তার দেশের গৃহহীন মানুষের জন্য হোটেলগুলো উন্মুক্ত করে দিয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আগপর্যন্ত সরকারি ব্যবস্থাপনায় ওই হোটেলগুলোয় গৃহহীন মানুষ থাকবেন। যুক্তরাজ্য সরকার ২৫ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
বাংলাদেশ কী করছে
করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি জেলায় ২০০ থেকে ৫০০ টন করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর নগদ টাকা দেওয়া হয়েছে দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা। জেলাগুলোর আয়তন ও জনসংখ্যাকে বিবেচনা নিয়ে ওই সহায়তা দেওয়া হয়েছে। লকডাউন হওয়া এলাকাগুলোয় খাদ্য সহায়তা বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। আর কোথাও ওষুধ বা অন্য কোনো সহায়তা দরকার হলে তা নগদ টাকা দিয়ে কিনে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে ১ লাখ ১০ হাজার খাবারের প্যাকেট তৈরি করা হয়েছে। তাতে ১০ কেজি চাল, ৫ কেজি আটা, দুই কেজি লবণ, এক কেজি চিনি, এক লিটার তেল ও নুডলস দেওয়া হয়েছে। কাদের ওই সহায়তা দেওয়া হবে তার তালিকা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে তৈরি করলে সেই তালিকা ও চাহিদা অনুযায়ী ওই খাবারের প্যাকেট জেলাগুলোয় পৌঁছে দেওয়া হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য, প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ওই সহায়তা দেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মোসাম্মাত নাজমানারা খানুম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খোলা বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে চাল ও আটা বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছি। অন্যান্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও চলছে। তবে চালের চেয়ে আটার চাহিদা এখন পর্যন্ত বেশি। সরকার থেকে আমাদের আরও কোণ কর্মসূচির মাধ্যমে খাবার বণ্টন করতে বললে আমরা প্রস্তুত আছি।’
কারা বেশি বিপদে
অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা বলছেন, ঢাকাসহ বড় শহরগুলোর দরিদ্র মানুষেরা এ ধরনের সমস্যায় সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন। গ্রামে কৃষিকাজসহ নানা কারণে সেখানকার দরিদ্রদের একধরনের সামাজিক নিরাপত্তা থাকে। কিন্তু শহরের গরিবদের আয়, বসতি, খাদ্য ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা শহরের অর্থনীতির সফলতার ওপরে নির্ভরশীল। শহরের অর্থনীতি কোনো কারণে অচল হয়ে গেলে সেখানকার গরিব মানুষেরা সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন। বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে খাবার কেনা সবকিছু তাঁরা নগদ অর্থ দিয়ে কিনে থাকেন। রিকশাচালক, পরিবহনশ্রমিক, হকার, তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিক, অন্যান্য শিল্পকারখানার শ্রমিক ও নিম্নস্তরের কর্মচারীরা এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার রাইটসের (বিলস) জরিপ অনুযায়ী, ঢাকা শহরে রিকশাচালক আছে ১১ লাখ। তাদের ওপরে নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ লাখ। এই রিকশাচালকদের ৯৪ শতাংশ বছরের বেশির ভাগ সময় নানা রোগবালাইতে ভোগেন। বিশেষ করে জ্বর-কাশি, ঠান্ডা, গায়ে ব্যথা, দুর্বলতা লেগেই থাকে। রিকশাচালকের পরিবারের মাসে গড় আয় ১৩ হাজার ৩৮২ টাকা। এর মধ্যে ৬৮ শতাংশই আছে রিকশা চালনা থেকে। ৯০ শতাংশ পরিবারের আয়ের উৎস রিকশা চালনা। এক-তৃতীয়াংশ চালকের কোনো ভূমি নেই।
পরিবহন খাতের সঙ্গে সারা দেশে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক জড়িত। আর তৈরি পোশাক খাত ও বস্ত্রকলগুলোয় মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪৫ লাখ। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেলে এসব শ্রমিকের খাদ্যের জোগান কোথা থেকে আসবে—এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকাসহ বেশির ভাগ বড় শহরে নিম্নবিত্ত মানুষেরা সাধারণত বস্তিতে থাকে। আমাদের জরিপে আমরা দেখেছি, এসব বস্তির ৪০ শতাংশ মানুষের জীবিকা অস্থায়ী ও বেশির ভাগই দিনমজুর। এসব শ্রমিক এখন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে। দ্রুত তাদের তালিকা করে খাদ্য সহায়তা হিসেবে পুষ্টি প্যাকেজ দিতে হবে। আর সামগ্রিকভাবে আগামী দিনের করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা করে এগোতে হবে।’
সুত্র-প্রথম আলো