করোনাকালের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। বেশিদিন আগের কথা নয়। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ মহামারী লেগেছিল। ইউরোপের দেশে দেশে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। ইউরোপ ছাড়িয়ে সেই মড়ক লেগে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক দেশে। ২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশ থেকে যে করোনার সূত্রপাত সেটি উহান ছাড়িয়ে চীনের ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় দাবানলের মত। তারপর সুপারসনিক গতিতে বিশ্বকে শাসন করতে শুরু করে। মাত্র কয়েক মাসে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
সেই মহামারী বাংলাদেশেও আঘাত হানে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী সনাক্ত হয়। তারপর ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। পরিস্তিতি জটিল আকার ধারণ করতে শুরু করে। পুরো বিশ্ব যেখানে কোভিড-১৯ নিয়ে চরম অস্থিরতার মধ্যে তখন বাংলাদেশের সামনে কোভিডের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। কিন্তু বাঙালি যে দমবার পাত্র নয়।
বিশ্বজুড়ে কোভিডের টিকা আবিস্কারের প্রতিযোগিতা শুরু হলো। বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব দ্রুত সেই টিকা আবিস্কারে মনোযোগ দিলো। বছর খানের মাথায় যখনই টিকা আবিস্কার একটা পর্যায়ে, তখন শুরু হলো কার আগে বা কোন দেশ কার আগে করোনার টিকা পাবে। যতো টাকার বিনিময়েই হোক।
কিন্তু টাকা থাকলেও তো টিকা পাওয়া কঠিন। এটা সবাই জানে। কারণ পৃথিবী ব্যাপী যে মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে তা সামাল দিতে যে পরিমাণ টিকার উৎপাদন হওয়া দরকার ওই সময়ে সেটা হচ্ছিল না। এই অবস্থায় বিশ্বজুড়ে রীতিমত টিকার জন্য হাহাকার শুরু হলো।
বাংলাদেশ সেই দৌড়ে এগিয়ে গেলো, বলতে গেলে সবার আগে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের পুরো কোভিড পরিস্থিতি নিজেই মনিটরিং করছিলেন। বাংলার একজন মানুষও যাতে বঞ্চিত না হয় সে জন্য তিনি সব ধরণের উদ্যোগ নেন। ইংল্যান্ড, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রসহ টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হলো। সেই যুদ্ধে বাংলাদেশ জয়ী হলো অবিশ্বাস্যভাবে। যে কয়টি উন্নয়নশীল দেশ প্রথম ধাপে টিকা পায় তারমধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে শেখ হাসিনার সরকার চড়া মূল্যে টিকা কিনে বিনামূল্যে সেটি মানুষের মধ্যে সরবরাহ করে। যদিও পরবর্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক চেষ্টা আর কূট্নৈতিক দক্ষতায় বাংলাদেশ করোনা টিকা ক্রয়ের পাশাপাশি বিনামূল্যেও টিকা পায়।
তবে শুরুর দিকে বাংলাদেশে যখন কোভিড ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে তখন দেশের মানুষকে এই অতীমারির হাত থেকে বাঁচাতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়। টানা ৬৫ দিন চলে লকডাউন। কিন্তু কোভিডকে তো আর লকডাউন দিয়ে আটকানো যায়নি। রাজধানীর গণ্ডি পেরিয়ে করোনা ছড়িয়ে পড়ে ৬৪ জেলায়, গ্রামে গঞ্জে। এই অবস্থায় সবচেয়ে বেশি সংকট দেখা দেয় চিকিৎসা ব্যবস্থায়। চিকিৎসক, নার্সরা সেবা দিতেও ভয় পাচ্ছিলেন। তার উপর এই চিকিৎসার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাও ছিলো না দেশের চিকিৎসকদের। এটি মোকাবেলা সরকারেরও কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো না। যার ফলে পরিস্তিতি সামাল দিতে প্রচণ্ড বেগ পেতে হয় সরকারকে।
প্রতিদিনই শহরের প্রধান প্রদান সড়ক থেকে শুরু করে অলিগলিতে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দে মানুষের ঘুম যেমন ভাঙ্গত। তেমনি গভীর রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সেই সাইরেনের শব্দই কানে বাজতে থাকে। হাসপাতালগুলোতে রোগীর ঠাঁই হচ্ছিল না। আইসিইউ আর ভেন্টিলেশন সংকটে রোগীদেরকে নিয়ে তাদের স্বজনরা এই হাসপাতাল, ওই হাসপাতাল করতে করতে এক সময় সেই প্রিয় মুখটি হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। এই যখন অবস্থা তখন মানুষ বাঁচাতে সরকারের তরফে নানামুখি পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
প্রথম ধাপে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে কোভিড-১৯ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। একই সঙ্গে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মহাখালী শেখ রাসেল গ্যাস্টো লিভার হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি হাসপাতালকে কোভিডের চিকিৎসার জন্য ডেডিকেটেড করে দেওয়া হয়।
দেশের সকল জেলা পর্যায়ে ১০০ বেড, উপজেলা পর্যায়ে ৪০ থেকে ৬০টি বেড, মেডিকেল কলেজগুলোতে ৩০০ বেড এবং রাজধানীর কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে ৫০০ থেকে ১০০০ বেড করোনা ভাইরাস আইসোলেটেড করে রাখা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য বিশেষ ভাতা চালু করা হয়। হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। একাধিক হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করা করা হয়। আইসিই ‘র সংখ্যা বাড়ানো হয়।
দেশে মহামারী নিয়ন্ত্রণে শেখ হাসিনার সরকারের সব পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের প্রতি তাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় কোভিড সরবরাহের মাধ্যমে। এভাবেই কোভিড-১৯ থেকে ধীরে ধীরে পরিত্রাণ পায় বাংলাদেশের মানুষ।
কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের বিশেষ উদ্যোগে তড়িৎ দুই হাজার চিকিৎসক এবং পাঁচ হাজার নার্স নিয়োগ দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে দেশে কোভিড মোকাবেলায় চার হাজার চিকিৎসক, ১৪ হাজার, ২১ হাজারের বেশি স্বেচ্ছাসেবকসহ প্রায় ৪০ হাজার জনবল কাজ করে। চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা চালু করা হয়।
ভ্যাকেসিনের দিক থেকে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশগুলো মধ্যে সেবার আগে যেমন কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন দিতে পেরেছে, তেমনি সারাদেশের সব বয়সী মানুষের মধ্যে চার ধাপে মোট সর্বমোট ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ ২১ হাজার ২৪৬ ডোজ টিকা দেয়। এসব টিকার মধ্যে সরকার নিজস্ব অর্থায়নে টিকার একটার বড় অংশ ক্রয় করে। বাকি টিকা বিনামূল্যে পেয়েছে। প্রথম ধাপে ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টিকা কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে প্রথম ধাপের টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে টিকার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ডোজ দেওয়া হয়। এখন চতুর্থ ডোজের কার্যক্রম চলমান।
বিশ্বব্যাপী যখন করোনায় লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে তখন বাংলাদেশে সেই হার খুবই কম। শেখ হাসিনার সরকারের সর্বাত্মক চেষ্টায় মহামারীর মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে বাঁচানো চেষ্টা করা হয়েছে এবং তাতে সফলতাও এসেছে। এ কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।