সরকারিভাবে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় ফি আরোপ করা হয়েছে। এখন থেকে বুথে গিয়ে নমুনা পরীক্ষার জন্য লাগবে ২০০ টাকা। বাসা থেকে নমুনা নিয়ে গেলে দিতে হবে ৫০০ টাকা। হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের নমুনা পরীক্ষার জন্যও ২০০ টাকা করে দিতে হবে। সোমবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিনামূল্যে করোনা পরীক্ষার সুযোগ থাকায় উপসর্গহীন ব্যক্তিরা বারবার সুযোগ নিচ্ছেন। এটা বন্ধেই নমুনা পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে আগে থেকেই বেসরকারি হাসপাতালে করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা নির্ধারণ করা আছে। বেসরকারিভাবে বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য দিতে হয় সাড়ে চার হাজার টাকা করে। এছাড়া কিছু বেসরকারি হাসপাতালে করোনা চিকিৎসার ব্যয় রোগীদেরই মেটাতে হচ্ছে। সব মিলে দেশে করোনা চিকিৎসার ব্যয় বাড়ছে। এতে পরীক্ষা কমবে ফলে সংক্রমণ বাড়বে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা না পাওয়ার ঘটনা নৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালে গিয়ে গুনতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। যদি কোভিড-১৯ রোগীর আইসিইউ বা অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, তাহলে খরচের বিষয় বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবের সঙ্গে যোগ হচ্ছে সরকারিভাবে নমুনা পরীক্ষার ফি। এতে চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ জনগণের আওতার বাইরে যাওয়ার পাশাপাশি চলমান মহামারী নিয়ন্ত্রণ দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেন। ফি’র কারণে অনেকেই নমুনা পরীক্ষায় উৎসাহ হারাবে। এতে সংক্রমণ নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াবেন। রোগটি ছড়িয়ে দেবেন সুস্থ মানুষের দেহে। এতে সংক্রমণ আরও বাড়বে।
তারা বলছেন, করোনা মহামারীতে শনাক্তকরণ পরীক্ষা ফি নির্ধারণ দেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করেছে। এমনিতেই দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের দায়িত্ব সরকারের। আর মহামারী অবস্থায় সব বেসরকারি হাসপাতাল আপৎকালীনের জন্য অধিগ্রহণ করে সর্বস্তরে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা উচিত। সেটি না করে ফি নির্ধারণের মতো অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন তারা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা-১ অধিশাখা থেকে রোববার (২৮ জুন) ফি নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। সরকারি সব হাসপাতালের জন্য এ ফি প্রযোজ্য হবে।
‘কোভিড-১৯ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ইউজার ফির হার নির্ধারণ’ শিরোনামের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, আরটি-পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে করোনাভাইরাস সংক্রমণ নির্ণয় করা হয়। বর্তমানে এ পরীক্ষা সরকার বিনামূল্যে করার সুযোগ দিচ্ছে। ফলে কোনো উপসর্গ ছাড়াই অধিকাংশ মানুষ এ পরীক্ষা করানোর সুযোগ গ্রহণ করছেন। এ অবস্থায় কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অপ্রয়োজনীয় টেস্ট পরিহার করার লক্ষ্যে অর্থ বিভাগের ১৫ জুনের এক স্মারকের সম্মতির পরিপ্রেক্ষিতে আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য ২০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি নির্ধারণ করা হল। আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য আদায় করা অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা করতে হবে। ‘চিকিৎসা সুবিধা বিধিমালা ১৯৭৪’-এর আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য চিকিৎসা সংক্রান্ত সব সুযোগ-সুবিধা বহাল থাকবে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা, দুস্থ ও গরিব রোগীদের চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত সরকারি আদেশ বহাল থাকবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে জনস্বার্থে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রজ্ঞাপনে।
এ প্রসঙ্গে আইইডিসিআর’র সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থবিদ ডা. মোশতাক হোসেন যুগান্তরকে বলেন, চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি এবং পরীক্ষার ফি নির্ধারণ মহামারী নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এই সময় উচিত সম্পূর্ণ বিনা খরচে রোগীদের সেবা দেয়া। তাছাড়া রাষ্ট্র দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এসব সিদ্ধান্তে মহামারী বিলম্বিত ও দীর্ঘায়িত হবে। তিনি বলেন, এতে বলা হয়েছে, এটা অপব্যবহার রোধে করা হয়েছে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় সেটি করা সম্ভব নয়। এতে শুধু দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের ন্যূনতম অধিকার খর্ব করা হল।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট পরিহার করতেই সরকার এই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু এই সিদ্ধান্তের ফলে সাধারণ মানুষের পরীক্ষার সুযোগ আরও সংকুচিত হল। এমনিতে একবার পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ লাইন ধরে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো। তাছাড়া কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা ব্যবস্থা অনলাইনে নিয়ে আসায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষে সেখানে সুযোগ নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে যাদের টাকা এবং ক্ষমতা আছে, তারা এখনও একাধিকবার পরীক্ষা করছে, ২০০ টাকা ফি দিয়েও করতে পারবে। এই ফি ক্ষমতাবানদের প্রভাব খাটানোয় কোনো প্রভাববিস্তার করতে পারবে না। তাছাড়া একটি পরীক্ষায় সরকারের ব্যয় হয় সাড়ে তিন হাজার টাকা, সেখানে মাত্র ২০০ টাকা নিয়ে সরকারের উল্লেখযোগ্য কোনো আয় হবে না।
পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, শুধু সুব্যবস্থাপনার অভাবে বাড়ছে করোনা চিকিৎসার ব্যয়। একই মানুষ একাধিকবার পরীক্ষা করছে, আবার অনেকে দিনের পর দিন অপেক্ষা করেও পরীক্ষা করাতে পারছেন না। তারা বলেন, মাহামারী নিয়ন্ত্রণে প্রথমেই আমাদের প্রস্তাব ছিল হাসপাতালে ট্রায়জ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সেটি করেনি। যদি ট্রায়জ নিশ্চিত হতো, তাহলে হাসপাতালে জরুরি বিভাগে আসা রোগীদের মধ্য থেকেই কোভিড, ননকোভিড আলাদা করা হতো। শুধু উপসর্গ রয়েছে- এমন রোগীদের নমুনা পরীক্ষা করা হতো এবং চিকিৎসা প্রদান করা হতো। এতে মানুষের বিড়ম্বনা এবং চিকিৎসা ব্যয় দুটোই নিয়ন্ত্রণ করা যেত।
তারা বলেন, স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে এখনও সাড়ে তিন হাজার শয্যার বসুন্ধরা ও ডিএসসিসি মার্কেট হাসপাতাল চালু করা সম্ভব হয়নি। ফলে কোভিড-১৯ রোগীদের শয্যা সংকট থেকেই গেছে। সমস্যা সমাধানে বেশকিছু বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। চুক্তি অনুযায়ী কোভিড-১৯ রোগীদের বিনামূল্যে টিকিৎসা দেয়ার কথা থাকলেও তারা সেটি মানছেন না। এতে রোগীরা বিড়ম্বনায় পড়লেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। উল্টো বিভিন্ন গুজবের কারণে সামর্থ্যবান মানুষ ঘরে ঘরে অক্সিজেন সিলেন্ডার, পাল্স অক্সিমিটারসহ বিভিন্ন জীবনরক্ষাকারী সরঞ্জাম কিনে মজুদ শুরু করেছে। এতে বাজারে সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে হাসপাতালগুলো চাহিদামতো সরঞ্জাম পাচ্ছে না। আবার যারা বাসায় এগুলো মজুদ করেছে, তাদের কোনো কাজে আসছে না। করোনায় চিকিৎসা ব্যয় বাড়ার এটিও অন্যতম কারণ।
এসব বিষয়ে গণস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফজুল হাকিম যুগান্তরকে বলেন, কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ একটি অমানবিক কাজ। মহামারীকালীন এসব রোগীর চিকিৎসা দেয়ার দায়িত্ব সরকারের। দেশের মানুষ রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। মানুষকে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে সরকার জনগণের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ন করছে।
চিকিৎসা ব্যয় প্রসঙ্গে ডা মোশতাক হোসেন বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সরকারের চুক্তি হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী তাদের যদি না পোষায়, তারা সরকারকে জানাবে। কিন্তু রোগীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা অনৈতিক এবং ব্যবসায়িক নৈতিকতার স্খলন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য কমিটির সদস্য সচিব ও উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার যুগান্তরকে বলেন, কিছু মানুষ ৭ থেকে ১০ বার করোনা পরীক্ষা করিয়েছে। তাদের বিড়ম্বনা থেকে বাঁচতেই সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বেসরকারি হাসপাতালগুলো রোগীদের কাছ থেকে বিপুল টাকা নেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের কাছে এ ধরনের কোনো লিখিত অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ এলে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।