চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়ে নিখোঁজ ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। কলকাতার একটি বাসায় ‘পরিকল্পিতভাবে খুন’ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেছেন, ভারতীয় পুলিশের কাছ থেকে এ বিষয়ে তথ্য পওয়ার পর বাংলাদেশের পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ঝিনাইদহ-৪ আসনের তিনবারের সংসদ সদস্য আনার কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। গত ১১ মে তিনি দর্শনা-গেদে সীমান্ত দিয়ে চিকিৎসার জন্য ভারতে যান।
কলকাতায় পৌঁছে তিনি ওঠেন তার বন্ধু, বরাহনগরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে। কিন্তু ১৬ মে থেকে তার সঙ্গে আর যোগাযোগ করতে পারছিল না বলে জানান তার পরিবার।
আনার নিখোঁজ জানিয়ে ১৮ মে বরাহনগর থানায় জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। সেখানে বলা হয়, ১৩ মে দুপুরে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। তবে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে আসা এক বার্তায় বলা হয়, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন।
এদিকে আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন পরে ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার বাবার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানান।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, পরের কয়েক দিনে দুই দেশের পুলিশের মধ্যে যোগাযোগের পর বুধবার সকালে কলকাতার সংবাদমাধ্যমে আনারের খুন হওয়ার খবর আসে। বলা হয়, নিউ টাউন এলাকার সঞ্জিভা গার্ডেন নামের বিলাসবহুল একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকে পাওয়া গেছে বাংলাদেশের এ সংসদ সদস্যের লাশ।
ভারতে তার মরদেহ উদ্ধারের সংবাদ পাওয়ার পর তার দলীয় কার্যালয়ে উপস্থিত শত শত মানুষ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। এমপি আনার জেলার কালীগঞ্জ শহরের ভূষণ রোড়স্থ বাড়িতে বসবাস করতেন। তার দুই মেয়ে স্ত্রী রয়েছে।
এমপির নির্বাচনী এলাকা কালীগঞ্জ উপজেলার ১নং সুন্দরপুর দূর্গাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওহিদুজ্জামান ওদু বলেন, আমরা তার মৃত্যু সংবাদ শুনে রাজনৈতিক কার্যারয়ের সামনে এসেছি। তার মৃতদে ভারতে পাওয়া গেছে। কিভাবে তার মৃত্যু হয়েছে তা বলতে পারছিনা। এমপির সাথে কারো কোন বিরোধ ছিল না। যা ছিল তা খুবই সামান্য কিন্তু তার জনপ্রিয়তা ছিল অনেক। তিনি বলেন তার পরিবার ঢাকাতে অবস্থান করবেন। তারা ঝিনাইদহের উদ্দেশ্যে রওয়া দিয়েছেন। তারা আসলে আরো কিছু জানা যাবে।
তিনি বলে রাষ্ট্রীয়ভাবে এমপির মরদেহ দেশে আনা হবে। আমরা এখন মরদেহের জন্য অপেক্ষা করছি।
ভারতে পৌছে পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার অন্তর্গত মন্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে পরিচিত এক ব্যক্তির বাড়িতে ওঠেন। পরের দিন ১৩ মে ডাক্তার দেখানোর জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। ১৫ মে বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাসের হোয়াটস এ্যাপে ম্যাসেজ করে জানান তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। ১৬ মে এমপির ব্যক্তিগত গাড়ি চালক তরিকুল ইসলামের ব্যক্তিগত মুঠোফোনেও একটি ম্যাসেজ পাঠিয়ে জানান দিল্লি যাওয়ার কথা। এরপর থেকে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যান আনোয়ারুল আজিম আনার। এরপর থকে পরিবার ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। তাকে ফোনে বা কোনো মাধ্যমে না পেয়ে বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে জানান উদ্বিগ্ন এমপি পরিবার। এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে ১৮ মে থানায় একটি মিসিং ডাইরি করেন এমপি’র পরিচিত ভারতের বরাহনগরের বাসিন্দা গোপাল বিশ্বাস।
আনোয়ারুল আজীম আনার ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকার দলীয় সংসদ সদস্য। তিনি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে টানা ৩ বার আওয়াামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দির্ঘ দশ বছর হলো তিনি এলাকার উন্নয়নে কাজ করছেন। সাংসদ হিসাবে বিভিন্ন সেবামূলক কাজের জন্য তার বেশ সুনাম রয়েছে। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকার গ্রামে গ্রামে গিয়ে মানুষের সাথে দেখা করে সমস্যা শোনেন ও সমাধান করেন। তিনি চলাচলের সময় কোন পুলিশ প্রটোকল ব্যবহার না করে একা একা চলতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। সবথেকে আলোচিত বিষয় তার নির্বাচনী এলাকায় যে কোন ব্যক্তি মারা গেলে তার বাড়িতে যান এবং শোকার্ত পরিবারকে শান্তনা দেন। এমনও হয়েছে তিনি একদিনে ১০ জন মৃত্যু ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সাথে দেখা করেছেন। এ পর্যন্ত তিনি পাঁচ সহাস্রাধিক মৃতু ব্যক্তির দোয়া অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। যা দেশের একজন জনপ্রতিনিধি হিসাবে বিরল।
এদিকে বুধবার সকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে আনারের খুন হওয়ার খবর আসে। তারপর দুপুরে ঢাকার ধানমন্ডিতে নিজের বাসায় পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল। বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যতটুকু তথ্য তারা পেয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের লোকজনই এ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। তিনজনকে গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি আরো কয়েকজনকে খোঁজা হচ্ছে।
“আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে আনোয়ারুল আজীমকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছে। ভারতের পুলিশ আমাদের যে তথ্য দিয়েছে, সে তথ্য অনুযায়ী আমাদের পুলিশ যারা খুন করেছে বা খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, আমরা যাদের সন্দেহ করছি, তাদের মধ্য থেকে তিনজন অপরাধীকে পুলিশ ধরেছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
আনারের বন্ধু গোপাল বিশ্বাসও বলেন, তিনি যে জিডি করেছিলেন, তার তদন্ত কর্মকর্তা শুভেন্দু গোস্বামী সকালে তাকে ফোন করে আনারের লাশ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছেন।
পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আমরা যতটুকু খবর পাচ্ছি, সে অনুযায়ী আমরা তদন্ত করছি” আনোয়ারুল আজীম আনার যে এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন, ঝিনাইদহ সীমান্তবর্তী ওই এলাকাটি একটি ‘সন্ত্রাসকবলিত’ এলাকা।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনন্ত্রী বলেন“আনোয়ারুল আজীম এবারও ওই এলাকার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। চিকিৎসার জন্য যাওয়ার (কলকাতায়) পর ওই ঘটনা ঘটে। আমাদের পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে। আমরা শিগগিরই এই খুনের মোটিভ কী ছিল তা আপনাদের জানাতে পারব। ভারতের পুলিশ আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করছে।”
মন্ত্রী আরও বলেন, সংসদ সদস্য আনারের খুন হওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী ভারতের পুলিশের সঙ্গে কাজ করছে বাংলাদেশ পুলিশ।
“তদন্ত শেষ হলে আপনাদের সবাইকে জানানো হবে তিনি কেন খুন হয়েছেন, কে কে খুন করেছে, কী ধরনের অস্ত্র দিয়ে খুন হয়েছেন।”
বাংলাদেশের একজন সংসদ সদস্য ভারতে গিয়ে খুন হলেন, এ ঘটনায় দুই দেশের সম্পর্কে ফাটল ধরবে কিনা এমন প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “ঘটনার পর থেকে ভারত আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছে। এখানে সম্পর্কে ফাটল ধরার মত কোন কিছু হয়নি। কারণ হত্যায় যুক্তরা সবাই বাংলাদেশি, এখানে কোনো ভারতীয় নেই।”
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং ঢাকার পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানও ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্রিফিংয়ের কিছুক্ষণ পর ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডোরিন।
তিনি বলেন, “আপনার সবাই ইতোমধ্যে জেনেছেন যে আমার বাবাকে হত্যা করা হয়ছে, এজন্য আমি ডিবি কার্যালয়ে এসেছি। এই মামলার মোট আসামি ৫ জন, ৩ জনকে ধরেছে। বাকিদের ধরার চেষ্টা করছে। সব বিষয়ে জানতে এবং মামলা করতে এসেছি।”
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয়েছে বলে জানান এমপি’র মেয়ে ডোরিনের, তিনি বলেন, “ডিবির সব কর্মকর্তা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন আসামিদের ধরার ব্যাপারে। আন্তরিকতার সঙ্গে তারা সহযোহিতা করছেন। আমি বাবা হত্যার বিচার চাই। খুনিদের শাস্তি দেখতে চাই। প্রকাশ্যে তাদের মৃত্যু দেখতে চাই।”
কাউকে সন্দেহ করছেন কি না এ প্রশ্নে এমপি আনারের মেয়ে বলেন, “আমি চিনি না। কিন্তু তাদের চিনতে চাই। কাউকে আমি সন্দেহ করছি না। কিন্তু খুনিদের পরিচয় জানতে চাই। তারপর আমি আমার সন্দেহের কথা প্রকাশ করব।”