বাঙালি চিরকালই জীবনরসিক, একইসাথে ভোজনরসিকও। বাঙালির বিয়ে হোক বা বৌভাত, কব্জি ডুবিয়ে উদরপূর্তি করা এ এক বড় পুরনো প্রথা। কালক্রমে খাইয়ে মানুষের সাথে হারিয়ে গেছে কলাপাতা কিম্বা পদ্মপাতায় অথবা মাটিরপাত্রে খানা খাওয়া। গ্রাম বাংলায় এখনও কিছু কিছু বিয়ে বাড়িতে খির পরিবেশন করা হয়। যতদুর মনে পড়ে কয়েক বছর আগে মেহেরপুর প্রতিদিনের প্রকাশক এম. এ. এস ইমন শিশু একাডেমিতে এমন বাঙালিয়ানা খাবার খাইয়েছিলেন এক অনুষ্ঠানে। সেই প্রথম আমার জীবনে পদ্ম পাতায় খাবার খাওয়া।
গ্রামে এক সময় কলা পাতা, পদ্মপাতায় খাবার খাওয়ার প্রচলন ছিলো। অনেকে তো আবার ঘরোয়া পিকনিকেও সখের বশে পদ্মপাতা, কলাপাতায় খেয়ে থাকে। তবে কলাপাতা, পদ্মপাতা, শালপাতার থালা, বাটি, শালপাতার উপর কলাপাতা মোড়া থালার চল এখন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অথচ একটা সময় কলাপাতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা একটা অঙ্গ ছিল। বর্তমানে এ্যালোমেনিয়াম, স্টিল, মেলামাইনের প্লেট, বাটির চল এখন সব জায়গায়। সস্তায় সহজলভ্য বলে সেগুলোর ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে দিন দিন। স্টিলের বা কাচের প্লেট ধোঁয়ার পরেও সাবানের রাসায়নিক কণা প্লেটে লেগে থাকতে পারে। যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। চিকিৎসকদের মত্যে কলাপাতায় পলিফেনল নামের একটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান থাকে। যখন কলাপাতায় গরম খাবার পরিবেশন করা হয়, তখন খাবারের সঙ্গে এই পলিফেনল মিশে শরীরে প্রবেশ করে। এর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। কলাপাতা সম্পূর্ণভাবে রাসায়নিকমুক্ত হওয়ায় এতে খাবার খাওয়া স্বাস্থ্য সম্মত। তাছাড়া কলাপাতা পরিবেশবান্ধব। তাই পরিবেশ দূষণেরও কোনো আশঙ্কা থাকেনা। একটা সময় গ্রাম গঞ্জে বড় ধরনের কোন অনুষ্ঠান হলেই তার খাবার পরিবেশন করা হত কলাপাতায়। এখন অবশ্য বিয়ে বাড়িতে কলাপাতায় খাবার পরিবেশনের রেওয়াজ বিলুপ্ত হয়েছে। একটা সময় বিয়ে সাদি কিম্বা কোন অনুষ্ঠানের কদিন আগে থেকেই কিশোর যুবকদের মধ্যে হিড়িক পড়ে যেত কলাপাতা, পদ্মপাতা সংগ্রহের। মজাও পেতো কিশোর যুবকরা। খাল বিলে বানিজ্যিক ভিত্তিতে মাছ চাষ এবং কলা এখন বানিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ পাতা সংকট একটা কারণও বটে।
পদ্ম ফুল এবং পাতার মধ্যে আছে ভেষজ গুণাগুণ। পদ্ম ফুল এপার বাংলা ওপার বাংলায় সপুষ্পক উদ্ভিদ নামে পরিচিত। পদ্ম পাতার মুল, ফল প্রতিটি অঙ্গই রোগ প্রতিরোধ করে। প্রসব পরবর্তী মায়েদের রোগ, জ¦র, অকালে গর্ভপাতসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসেবে কাজ করে এই পদ্ম পাতা এবং ফুল। সনাতন ধর্মের দূর্গা পূজায় এই ফুল ব্যবহার হয়।
কুড়িবছর আগেও কলাপাতা ও পদ্মপাতা ছাড়া কোন মজলিসে খাবার পরিবেশন হতো না। প্রবীনদের মতে কলাপাতায় খাওয়ার মজাই আলাদা। জিয়াফতের ডাল-ভাত, খিচুড়ি খাওয়া আজ যেন প্রবীনদের কাছে শুধুই স্মৃতি। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও এতদিন টিকে ছিলো পদ্মপাতা কিম্বা কলাপাতায় শিরনি প্রসাদ পরিবেশনের। তাও হারিয়ে যাচ্ছে।
কলাপাতা ও পদদ্মপাতায় খাওয়ানো লাভজনক ও সস্তা বিকল্পগুলোর একটি। প্রচুর মানুষকে একসঙ্গে খাওয়াতে বাড়তি খরচের বোঝা নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। শুধু কলাগাছ থেকে পাতা কেটে এনে ও জলাশয় থেকে পদ্মপাতা সংগ্রহ করে পানি দিয়ে ধুয়ে খাবার সাজালেই হয়ে যায়।
পাতায় খাওয়া বঙ্গ সমাজের রীতি। শুধু বঙ্গ সমাজ কেন? দক্ষিণ ভারতেও কলাপাতায় খাওয়ার প্রচলন আছে। এখনও অনেক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয় পাতা। পাতায় খাবার খেলে তা থাকে রাসায়নিকমুক্ত।
একটা সময় ছিল স্বচ্ছল পরিবারের পাশাপাশি সেকালে মধ্যবিত্ত গৃহস্থ পরিবারেও বিয়ে, বৌভাতে ভোজের ব্যবস্থা ভালোই ছিল। চমকদারি না থাকলেও সে ভোজে আন্তরিকতার স্পর্শ থাকতো। খাওয়া হতো বাড়ির উঠানে সামিয়ানা বেঁধে। আসন, চাটাই পাতা হতো। খাওয়া হতো কলাপাতায় আর পানি দেওয়া হতো মাটির গ্লাসে।
সময়ের সঙ্গে মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। বাঙালি জীবনও তার ব্যতিক্রম নয়। একালের বাঙালির বিয়েতে ভাড়া বাড়িই ভরসা। আর খাওয়া দাওয়ার দায়িত্ব পড়ে কেটারিং এর ওপর। অর্থ-ক্ষমতার গৌরব সেকালের মতো একালেও আছে। নামি কেটারিংয়ের বিরিয়ানি, মোগলাই, চাইনিজ, কন্টিনেন্টাল খানা পরিবেশন করে তাক লাগিয়ে দেয়া হয় অতিথিদের। অদৃশ্য হয়ে গেছে কলাপাতায় খাওয়া। দেখা যায় না আর কলাপাতা ও মাটির থালা। আসনের বদলে জায়গা করে নিয়েছে চেয়ার টেবিল অথবা বুফে। নিজেই পছন্দমতো খাবার তুলে গল্প করতে করতে দাঁড়িয়ে খাওয়া।
একালে বিয়ে বাড়ির বুফেতে সাজানো থাকে হরেক রকমের রঙবেরঙের স্যালাড। আর দেখা যায় না সেই সব ‘খাইয়ে মানুষদের’। যারা বিশখানা মাছের টুকরো, কেজিখানেক গোসতো বা পঞ্চাশটা রসগোল্লা অনায়াসে খেয়ে নিতেন বিনা ক্লান্তিতে। তাঁরাও হারিয়ে গিয়েছেন সেকালের বিয়ের ভোজের মতো। এখনকার অনুষ্ঠানগুলোতে বয়োবৃদ্ধরা কোন দাওয়াতে আনন্দের সাথে কিছুটা স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েন। তাদের মনের স্মৃতির কুঠুরিতে আজো উঁকি দেয় বিয়ের সেসব দিনের ইতিকথা।
তথ্যসহায়ক : আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্রাচার্যের চিরঞ্জীব বনৌষধি
এবং
তোজাম্মেল আযমের মেহেরপুরের সংস্কৃতি ও লোক ঐতিহ্য।
লেখক: বাসস ও সংবাদ প্রতিদিন, মেহেরপুর প্রতিনিধি