সকালে বুয়ার কাজ, বিকালে চা দোকানী আর রাতে দর্জির কাজ। এভাবেই সেই কাক ডাকা ভোরে উঠে গভীর রাত পর্যন্ত চলে বন্যা মন্ডলের জীবন সংগ্রাম। বন্যা মন্ডলের হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের এই রোজগারেই চলে ৪ সদস্যের পরিবারের ভরণ পোষণ।
প্রতিবন্ধী স্বামী, কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ও ছেলের লেখাপড়াও চলে এই রোজগারেই। অথর্ব স্বামী ও দুই সন্তান নিয়ে বন্যা মন্ডল বাস করেন জীর্ণ টিনের তৈরী একটি ছোট্ট ঘরে। সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনিতে তার ক্লান্তি নেই। শুধু এখন প্রয়োজন একটা মাথা গোঁজার ঠাই। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছে একাধিকবার আবেদন করেছেন। মুজিবনগরের ইউএনও তার বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু গত ২/৩ বছরেও তার ভাগ্যে জোটেনি একটি সরকারি ঘর।
বন্যা মন্ডল মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামের মাইকেল মন্ডলের স্ত্রী। রতনপুর চার্চের পাশেই এক টুকরো সংরকারি জমির উপর একটি জীর্ণ ঘরেই এই অসহায় পরিবারের বসবাস।
বন্যা মন্ডলের স্বামী মাইকেল মন্ডল। পেশায় ছিলেন একজন ক্ষুদ্র কাঠ ব্যবসায়ী ও কৃষি শ্রমিক। একদিন মাঠে ভূট্টা ক্ষেতে কাজ করার সময় ডান পায়ের একটি আঙ্গুল ভূট্টার গোড়ার অবশিষ্ট অংশ (মোথা) ধাক্কায় ক্ষত হয়। সেই ক্ষত থেকে তার পায়ে গ্যাঙরিন নামক এক ধরনের পচনশীল রোগে আক্রান্ত হন। প্রায় ৮ বছর আগে তার প্রথম অপারেশনে পায়ের হাটু পর্যন্ত কেটে ফেলে দিতে হয়। কাটার পরেও তিনি কারো কাছে হাত না পেতে ব্যাটারিচালিত পাখি ভ্যান চালিয়ে জীবন ধারণ করেন। কিন্তু পরে আবারো পচন দেখা দিলে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল থেকে অপারেশন করে পুরো পা বিচ্ছিন্ন করে দেন চিকিৎসক। এর কিছুদিন যেতে না যেতেই মাইকেল মন্ডল ব্রেইন স্টোক করেন। তার পর থেকেই স্ত্রী বন্যা মন্ডল পুরো সংসারের হাল ধরেন।
সরে জমিনে দেখা গেছে, মাত্র একটি জীর্ণ ঘরেই মাইকেল মন্ডল বন্যা মন্ডল ও তাদের মেয়ে মেঘলা মন্ডল বসবাস করেন। আর ছেলে সোহাগ মন্ডল বাস করেন ছোট্ট রান্না ঘরে। সোহাগ মন্ডল গাংনী সন্ধানী স্কুল এন্ড কলেজের নার্সিং ইন্সটিটিউট থেকে নার্সিং ডিপ্লোমা করে মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নশীপ করছে। মেয়ে মেঘলা মন্ডল মেহেরপুর সরকারি মহিলা কলেজে এইসএসসি পরীক্ষার্থী।
সোহাগ মন্ডল বলেন, মায়ের রোজগারে সংসার কোনরকম চলে। আমাদের দু ভাই বোনের লেখাপড়ার খরচ চালানো সম্ভব হয়না। আমি হাইস্কুলে পড়া অব্স্থায় পাখি ভ্যান চালিয়ে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। আর এখন নার্সিং পড়া অবস্থায় একবেলা জনপাট (স্থানীয় ভাষায় মুনিষ) খেটে ২ শ থেকে আড়াইশ টাকা পাই সেটা দিয়ে আমার পড়া লেখার খরচ যোগায়।
সোহাগ আরো বলেন, আমার বোন পঞ্চম শ্রেনী ও এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। সে খুব ভাল ছাত্রী। কিন্তু আমাদের পরিবার পারছেনা তার জন্য কিছুই করতে। আমরা দু ভাই বোন লেখাপড়া শেষ করে পরিবারের হাল ধরবো, বাবাকে ভাল হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলবো। আমি হেসেল ঘরে (রান্না ঘর) থেকে লেখাপড়া করছি এজন্য আমার কষ্ট হয়না। আমাকে আমার পিতা মাতা এই পৃথিবীর আলোর মুখ দেখিয়েছেন। আমি আজীবন তাদের পাশে থেকে তাদের সেবা করবো।
বন্যা মন্ডল বলেন, আমার দুটি সন্তান খুব ভাল। তারা বলে, মা তোমরা আর কয়টা দিন অপেক্ষা করো। ইশ্বর আমাদের দিকে মুখ তুলে তাকাবেন। আমরা বড় হয়ে তোমাদের সব কষ্ট দুর করবো।
প্রতিবন্ধী মাইকেল মন্ডল বলেন, সরকারিভাবে আমি এখনও কোনো কিছু পাইনি। তবে, একটা প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড থেকে মাসে সাড়ে ৭ শ টাকা পাই। অনেকেই এসেছে সাহায্য সহযোগীতা করবে বলে। কিন্তু কেউ আর এগিয়ে আসেনি।
বাগোয়ান ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ড রতনপুরের ইউপি সদস্য বাবলু মন্ডল বলেন, আমি তার প্রতিবন্ধী ভাতা কার্ড করে দিয়েছি। তাকে একটা ঘর দেওয়ার জন্য প্রশাসনের কাছেও গিয়েছি। মুজিবনগরের ইউএনও সদ্য বিদায়ী সুজন সরকার নিজে তার বাড়িতে গিয়েছিলেন। ঘর দেওয়ার জন্যও প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, মাইকেল মন্ডল ঘর পাওয়ার জন্য শতভাগ উপযুক্ত।
এব্যাপারে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক ড. মুনসুর আলম খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশ্বস্থ্য করেন। তিনি বলেন, আমি আপাতত তার চলাচলের জন্য একটা হুইল চেয়ার ও চায়ের দোকানের জন্য নগদ কিছু টাকা প্রদান করতে পারবো। এবং তার জন্য সরকারি ঘর যাতে বরাদ্দ হয়, সে ব্যাপারেও দ্রুত পদক্ষেপ নেবো।