কলুর ঘাড়ে ঘানি, চোখের ওপর মোটা কাপড়ের পর্দা দেয়া কলুর বলদ চলছে। কাঠের তৈরী ঘানিটা ঘুরছে, আর সরিষা পিষেতা থেকে তেল বেরুচ্ছে। ধীরে ধীরে মাটির পাত্রে সরিষার তেল। এভাবে তৈরি হয় খাঁটি সরিষার তেল। এর ঝাঁঝালো গন্ধে চোখে পানি এসে যায়।
বলছিলাম কুষ্টিয়ার কুমার খালী উপজেলার শেরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমানের কাঠের ঘানিতে সরিষার তেল তৈরীর কথা। কয়েক বছর আগেও একমাত্র এই ঘানি ভাঙানো সরিষার তেল দিয়েই মিটতাসে কল পরিবারের তেলের চাহিদা।
বর্তমানে এখন আর এই ঘানি প্রত্যন্ত গ্রামে ও খুজে পাওয়া যায় না। তাই খাঁটি সরিষার তেলও মেলে খুব কম। বর্তমানের ভেজালের দিনে শতভাগ খাঁটি জিনিস খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এ কারণে তার ক্রেতা ও বেশি।
শুধু এলাকার মানুষ তার এ খাঁটি তেল কেনেন না, জেলা শহর থেকেও আগ্রহী ক্রেতারা এসে তেল নিয়ে যায় মিজানুর রহমান। কুষ্টিয়ার কুমার খালী উপজেলার শেরকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। এক সময় সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন সুদুর মধ্য প্রাচ্যের দেশ ওমানে।
হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে দিনরাত খেয়ে না খেয়ে কাটিয়েছেন বিদেশে। ৫ বছর বিদেশ থাকার পর এক সড়ক দূর্ঘটনায় তার দুই পা ভেঙে যায়। এরপর আর বিদেশ থাকা হয়নি তার। দেশে ফিরে এসে যৎসামান্য টাকা আর হালের দুইটি বলদ দিয়ে শুরু করেন পৈত্রিক ব্যাবসা।
নিজের সংসারের হাল ফেরানো আর মানুষকে ভালো খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করে চলেছেন তিনি। শুরু করেছেন ঘানিতে সরিয়া পিশে তেল তৈরী করে বিক্রির কাজ। আর তার এই কাজে অনুপ্রেরনা যুগিয়েছেন তার মা।
আব্দুল্লাহ শাহ নামের এক ক্রেতা জানান, এক সময়ে কাঠের ঘানির সাহায্যে ফোঁটায় ফোঁটায় নিংড়ানো খাঁটি সরিষার তেল এক সময় কুষ্টিয়ার বিভিন্ন গ্রাম গঞ্জের হাট বাজারে বিক্রি হতো। এ তেল বিক্রি করেই জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতেন কলু স¤প্রদায়রা।
তবে এক সময়ের গ্রাম বাংলার এই অতিপরিচিত দৃশ্যটি এখন খুব একটা চোখে পড়েনা। বৈদ্যুতিক যন্ত্রেই করা হয় তেল ভাঙানোর কাজ।
মিজানুর রহমান বলেন, বিদেশ যাওয়ার কয়েক বছর পর সড়ক দূর্ঘটনায় ফিরে আসি। সে সময় দেশে ফিরে বাড়ীতেই হালের বলদ দিয়ে শুরু করি পৈত্রিক ব্যাবসা। ৫ কেজি সরিষা থেকে প্রায় আড়াই কেজি তেল তৈরী হয়। আমরা এই তেল এখান থেকেই ১২০ টাকা কেজি প্রতি বিক্রি করে থাকি। অনেকেই এই ঘানি দেখতে আসে এবং তেল কিনে নিয়ে যায়।
ফজল শাহ নামের এক বৃদ্ধ বলেন, আগে তো আমরাই সরিষার তেল দিয়েই তরকারী খেতাম, ভর্তা ভাজি খেতাম, শরীরে মাখতাম। আর এখন অনেক টাই কমে গেছে এর ব্যবহার। তাছাড়া ভেজালের ভীড়ে আমরা হারিয়ে যেতে বসেছি আসল কেই। যদি কোন ভেজাল না মেশানো হয় তা হলে এই তেলের উপরে আর কোন তেল নেই।
মার্কেটিং আর চটকদার বিজ্ঞাপনের জন্য সবাই ভুলতেই বসেছেন আসল-নকলের পার্থক্য। তবে মিজানের ঘানি দেখতে প্রতিদিনই আসে আগ্রহী ক্রেতা আর দর্শনার্থীরা।