কালের বিবর্তনে হারাতে বসেছে মৃৎশিল্প। যেখানে তৈরী হতো মাটির হাঁড়ি পাতিল, থালা, গ্লাস সহ নিত্য প্রয়োজনীয় তৈজসপত্র। সেসব বাজার এখন দখল করে নিয়েছে প্লাষ্টিক ও এ্যলুমিনিয়াম এর পন্য। তবে এখনও মাটির আধুনিক মানের তৈজসপত্র তৈরী করছে কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কল্যানপুর মৃৎশিল্প সমবায় সমিতি লিঃ।
এখানকার উৎপাদিন পণ্য স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। তবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মূলধনের অভাবে চাহিদা মত পন্য সরবরাহ করতে পারছে না তারা। তবে অধিকাংশ ক্ষুদ্র শিল্পের মতন এখানেও রয়েছে পুঁজির সংকট। কোন কাজ না থাকায় খুবই সামান্য বেতনে কাজ করে জীবনযাপন করছে এখানকার শ্রমিকরা।
সম্প্রতি কল্যানপুর মৃৎশিল্প ঘুরে দেখা গেছে সেখানে প্রায় ৪০-৫০ জন্য নারী ও পুরুষ শ্রমিক কাজ করছে। কেউবা মাটি আর পানি দিয়ে কাদা তৈরী করছে, কেউবা থালা,বাটি, আবার কেউবা গ্লাস তৈরী করছে। কেউ আবার শুকানোর পর তা যত্মসহকারে পরিষ্কার করছে।
সেখানকার দায়িত্বরত ম্যানেজার রাজকুমার জানান, এই শিল্পের অতীত ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধশালী। হাঁড়িপাতিল থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার হতো মৃৎশিল্পের নানা তৈজসপত্র। আমরা এখানে মাটির তৈরী বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র তৈরী করে থাকি।
সাকিরন নেছা নামের এক নারীকর্মী জানান, মাত্র তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে কাজ করতে হয়। স্বামী মারা গেছে। একটা মেয়ে আছে কোন উপায় না পেয়ে সংসার চালাতে এই কাজ বেছে নিয়েছে।
নাজমা খাতুন নামের এরও এক নারী কর্মী জানান, এখান কাজ করে মাস শেষে যে বেতন দেয় তার তিনভাগের এক ভাগ যাতায়াত বাবদই শেষ হয়ে যায়। তবুও কিছু করার নেই। সংষার চালাতে বাধ্য হয়ে আমাকে এই কাজ করতেই হয়।
কল্যানপুর মৃৎশিল্প’র পরিচালক বটোকৃষ্ণ পাল জানান, আমার এই প্রতিষ্ঠানে ৬০ জন শ্রমিক কাজ করে। আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মূলধনের অভাবে চাহিদা মোতাবেক পণ্য সরবরাহ করতে পারছি না। ২০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটি সমবায় বরাবর দাখিল করলেও তা এখনও অনুমোদন হয়নি।
মৃৎশিল্প থেকে কেনাকাটা করতে আসা হাবিবুল আলম বলেন, বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে হাজার বছরের ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্য বাঙালি বুকে লালন ও পালন করে আসছে যুগ যুগ ধরে। তেমনি বাংলার এক শিল্প মৃৎশিল্প। এই শিল্পের অতীত ঐতিহ্য খুবই সমৃদ্ধশালী। হাঁড়িপাতিল থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার হতো মৃৎশিল্পের নানা তৈজসপত্র। তবে এখন আর সেসবের অনেকটাই নেই বললেই চলে। আমি পরিবার পরিজন নিয়ে এই মৃৎশিল্প ঘুরতে এসেছি। পাশাপাশি পছন্দসই সব তৈজসপত্র এখান থেকে ক্রয় করেছি।
কুষ্টিয়া জেলা সমবায় কার্যালয়ের কর্মকর্তা মিজানুর রহমান জানান, প্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের ব্যবহার কমে গেছে অনেকাংশে, আর এ শিল্পের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকসহ অন্যান্য সামগ্রী। এগুলো স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। তবু এগুলো ব্যবহার হচ্ছে অবলীলায়। তবে কুষ্টিয়ার তৈরী এই মাটির পাত্র আবার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে নতুন করে। তিনি আরও জানান, একটি প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটি সমবায় বরাবর দাখিল করলেও তা এখনও অনুমোদন হয়নি। ইতিমধ্যে প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ন বিবেচনা করে বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। আশা করি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এই মৃৎশিল্পের হারানো গৌরব ফিরে পাবে। পাশাপাশি আরও অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে।
মৃৎশিল্প একসময়ে বিলুপ্ত হয়ে গেলেও বাঙালির জীবন থেকে এই শিল্প একেবার মুছে যাবে না। হাজার বছর ধরে এসব পণ্য কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে আমাদের সংস্কৃতির সাথে। তাই এই শিল্পকে বাাঁচাতে সরকারকে উদ্দোগী হতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।