প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা অর্জন, পুকুর-খাল-কূপ খনন, গরুর প্রজনন, আলু ও ধান চাষ শেখা, লিফট দেখা- এ রকম নানা তুচ্ছ বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে সমালোচনা আছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। অহেতুক বিদেশ সফর না করতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা থাকলেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর ও অধিদফতর যেন তা ভুলেই গেছে। সর্বশেষ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে খিচুড়ি রান্না ও বিতরণ পদ্ধতি জানতে ১ হাজার কর্মকর্তাকে পর্যায়ক্রমে বিদেশ সফর করানোর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের একটি প্রস্তাব নিয়ে সর্বত্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। অধিদফতরের ওই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর পর তা জানাজানি হয়।
শুধু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরই নয়, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দফতর থেকে এ রকম আরও অনেক প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য বিভিন্ন সময়ে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এর কোনোটি অনুমোদন পেয়েছে, আবার কোনোটি বাতিল হয়েছে কিংবা সংশোধন করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতা, রান্না শেখা, ধান ও আলু চাষ শেখা, লিফট দেখাসহ বিভিন্ন অজুহাতে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ মূলত সরকারি অর্থের অপচয়। এ ধরনের অবাস্তব, পরিকল্পনাহীন চিন্তাভাবনা বাদ দেওয়া দরকার। তা না হলে কেবল অর্থের অপচয় হবে। জনগণের কোনো উপকার হবে না।
জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকল্পগুলো যখন পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য যায় কিংবা ক্ষেত্রবিশেষ একনেকে যায় তখনই এগুলো ভালো করে যাচাই-বাছাই করে দেখা উচিত।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষেত্রবিশেষ কোনো কোনো প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণ দরকার আছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে দরকার নেই। সে প্রয়োজনীয়তা বুঝতে হবে। তবে এ প্রবণতা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত।’
জানা গেছে, ১ হাজার সরকারি কর্মকর্তাকে স্কুল ফিডিং কর্মসূচির আওতায় অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব করেছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর। এতে পাঁচ বছরে ১ হাজার কর্মকর্তাকে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কীভাবে খিচুড়ি রান্না করতে হয় এবং তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হয় সে বিষয়ে তারা ধারণা নিতে পারবেন। তারা এ ধরনের প্রকল্পের জন্য বাজার থেকে কীভাবে দ্রব্যাদি কিনতে হয়, রান্নার নিয়ম ও তা বিতরণের উপায় সম্পর্কে ধারণা নেবেন। আর এ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, পরিকল্পনা কমিশন এবং বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের কর্মকর্তারা বিদেশ সফরের সুযোগ পাবেন। এজন্য প্রাথমিকভাবে ৫ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে প্রস্তাবে।
এর আগে গত বছরের আগস্টে পুকুর খনন শিখতে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) ‘ভূ-উপরিস্থ পানির সর্বোত্তম ব্যবহার ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নাটোর জেলায় সেচ সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ১৬ জন কর্মকর্তাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর একটি প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেয়। ১৬ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ বাবদ বরাদ্দ ছিল ১ কোটি ২৮ লাখ টাকা। জনপ্রতি ৮ লাখ টাকা। কূপ খনন শিখতে অন্য আরেকটি প্রকল্পের আওতায় আরও ১৬ কর্মকর্তাকে ইউরোপ বা প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দেশে পাঠানো হয়।
একইভাবে বাঁধ পুনরুদ্ধার, তীররক্ষা ও নদী-খাল খননের কৌশল শিখতে আমেরিকা-ইংল্যান্ড গিয়েছেন বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের একটি দল। যাদের তিনজনই অবসরে গেছেন যথাক্রমে ২০ দিন, পাঁচ মাস ও এক বছরের মধ্যে। এর মধ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবও ছিলেন।
এর আগে কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পে তেলজাতীয় ফসলের চাষ শিখতে ও মৌ পালনে প্রশিক্ষণ নিতে ৪০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠানো এবং ৩৬ কর্মকর্তাকে শিক্ষা সফরে পাঠানোর একটি প্রস্তাব যায় পরিকল্পনা কমিশনে। শেষ পর্যন্ত ওই প্রকল্পে বিদেশ সফরে কর্মকর্তাদের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়।
গরুর প্রজনন দেখতে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফরের একটি প্রস্তাব গত মাসে বাতিল করা হয় তীব্র সমালোচনার মুখে। গরুর প্রজননজ্ঞান অর্জনে এসব কর্মকর্তার চারটি দেশে যাওয়ার কথা ছিল। যেখানে সরকারের প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয় হতো। একইভাবে ফল উৎপাদন শিখতে বিদেশ সফরের জন্যও একটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। ‘ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পে’ বিদেশ সফর এবং প্রশিক্ষণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি ১০ লাখ টাকা।
গত বছর ডিসেম্বরে বোয়িংয়ের একটি বিমান ডেলিভারি আনতে মন্ত্রণালয় ও বিমানের ৪৫ কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে গিয়েছিলেন। এর আগে একটি ক্যামেরা কিনতে তিনজনের বিদেশ যাওয়ার ঘটনায়ও সমালোচনা হয়েছিল।
এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে নতুন সড়ক নির্মাণের প্রশিক্ষণ নিতে, দেশের সব কারাগারে স্বজন লিংক স্থাপনে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা ও আর্জেন্টিনা সফর, আলু চাষ দেখতে ইউরোপ, লিফট দেখতে কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আট শিক্ষক ও কর্মকর্তার সুইজারল্যান্ড ও স্পেন এবং ফ্ল্যাট দেখতে থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুর যাওয়ার খবর সংবাদমাধ্যমে এসছে। এ নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। সরকার হয়েছে বিব্রত।
প্রকল্প করে প্রশিক্ষণ, অভিজ্ঞতার নামে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়ন দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণকে সুযোগ-সুবিধা গ্রহণের উপায় হিসেবে দেখা হয়। এটিই এখন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে অবাস্তব প্রশিক্ষণের নামে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়। এমন অবাস্তব প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণ করা উচিত নয়। সরকারের উচিত হবে এটি বাতিল করা।
যারা এমন অবাস্তব প্রস্তাব দেয় তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা।’ তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি সত্যিকার অর্থে জ্ঞানের ঘাটতি থাকে তবে সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হতে পারে। তবে এটি বাস্তবসম্মত ও সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। যাদের প্রশিক্ষণে পাঠানো হবে তারা যেন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, যাদের বিদেশে প্রশিক্ষণে পাঠানো হয় তারা প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে না। অথবা অনেকের প্রশিক্ষণ থেকে ফিরে আসার পর বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকে না।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সম্প্রতি এমন অবাস্তব বেশ কিছু প্রশিক্ষণ প্রস্তাব পুরো দেশবাসীকে বিব্রত করেছে। অনিয়ম, দুর্নীতি কী ধরনের হয় তার প্রকারভেদ জানার জন্য বিশ্ববাসীকে বাংলাদেশে আসা উচিত বলে আমি মনে করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে মিড ডে মিল কীভাবে তৈরি করতে হবে তার প্রশিক্ষণ নিতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ যেতে হবে এটা হাস্যকর ও অবাস্তব প্রস্তাব। এটা সম্পূর্ণ নিষ্প্রয়োজন।’
পুরো ব্যবস্থাপনা দেখতেই প্রশিক্ষণ প্রস্তাব করা হয়েছে : প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘খিচুড়ি রান্না শিখতে নয়, পুরো ব্যবস্থাপনা দেখতেই কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ প্রস্তাব করা হয়েছে।’
সচিব বলেন, ‘প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন হয়নি। পিইসি মিটিংয়ে আমাদের কাছে কিছু বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে। আমরা জবাব দেব। জবাবে তারা সন্তুষ্ট হলে প্রস্তাবটি একনেকে উত্থাপন হবে।’ তিনি বলেন, ‘মন্ত্রিসভায় স্কুল ফিডিং পলিসি অনুমোদিত হয়েছে। এ পলিসির ভিত্তিতে ১৯ হাজার ২৯৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে দাখিল করেছি। ৬৫ হাজার ৬২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১ কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর জন্য মিড ডে মিল চালু করতে হবে।
কীভাবে ম্যানেজ করব? সে ম্যানেজমেন্ট দেখার জন্য আসলে যেসব উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে এ ব্যবস্থা চালু আছে সে ব্যবস্থা দেখার জন্য এবং দেশে-বিদেশে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি কমপোনেন্ট রয়েছে সক্ষমতা অর্জনের জন্য। খিচুড়ি রান্না করার জন্য আমরা কোনো কর্মকর্তা বা আমরা বিদেশে যাচ্ছি না।’
সূত্র- বিডি প্রতিদিন