সারাবছর ধানের জমিতে পানি সেচ পাওয়ায় কুষ্টিয়ার গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের আওতাধীন কৃষকদের মুখে হাসি ফুটেছে। এমনকি বোরো মৌসুমেও দিতে হয়নি বাড়তি পানি সেচ।
এর ফলে বেঁচে গেছে কৃষকদের সেচ খরচ। শুষ্ক মৌসুমেও পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করেছে গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প। এদিকে তিন মৌসুমে পানি সেচ পাওয়ায় বেড়েছে ধানের আবাদ। আর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার ধানের বাম্পার ফলনের আশা কৃষি অধিদপ্তরের।
আর কম খরচে এবার বোরো ধান আবাদ করে খুশি কৃষকরা। কয়েক বছর আগেও আউস ও আমন ধানের ক্ষেতে নাম মাত্র পানি পাওয়া যেত জিকে সেচ খাল থেকে। আর বোরো ধান হতো সম্পূর্ণ কৃষকদের সেচ পাম্প দিয়ে। এতে ধান উৎপাদনে বাড়তি খরচ হতো কৃষকদের। কিন্তু এ বছর তিন মৌসুমেই পানি ছিল জিকে সেচ খালে। ফলে বেড়েছে বোরো ধানচাষির সংখ্যাও।
জিকে সেচ প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা ও ঝিনাইদহ জেলার ১৩ উপজেলার প্রথমে ৪ লাখ ৮৮ হাজার একর জমি সেচের আওতায় এনে ১৯৬৯ সালে শুরু হয় জিকে সেচ প্রকল্পের কাজ।
পানির অভাবে প্রতিবছর কোটি-কোটি টাকা ব্যয়ে ইনটেক চ্যানেল ছাড়াও পদ্মার উজান মুখে ড্রেজিং করে সেচ প্রকল্পটি চালু রাখা হয়। এদিকে ২০০৫ সালে স্থাপিত গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের তিন নম্বর পাম্পটি ২০১৭ সালের ১৯ এপ্রিল অকেজো হয়ে পড়ে। এরপর চার বছর দু’টি পাম্প দিয়েই চলে সেচ কাজ। যার ফলে কমতে থাকে এর আওতাধীন কৃষি জমি। পরে ২০২১ সালের নভেম্বরে অকেজো পাম্পটি সচল হয়। যার ফলে বোরো মৌসুমেও পর্যাপ্ত পানি পান কৃষকরা।
গত দুই বছর আগেও জিকে সেচ প্রকল্পের খালে পানি না থাকায় শুকিয়ে যেত বোরো ধানের জমি। কৃষকরা বাড়তি সেচ দিতে গিয়ে হিমশিম খেতেন। উৎপাদন খরচ বাড়তো দ্বিগুণ। কিন্তু এ বছর পাল্টে গেছে কুষ্টিয়ার জিকে সেচের আওতাধীন বোরো চাষিদের অবস্থা। পুরো মৌসুম জুড়ে জমিতে বাড়তি সেচ দিতে হয়নি। পর্যাপ্ত পানি পাওয়ায় মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ। বোরো ধান দেখে খুশি কৃষকরা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার আমলা ইউনিয়নের কচুবাড়ীয়া মাঠের ধান চাষি সাইদুল ইসলাম বলেন, ডিজেলের যে দাম, আর বোরো ধানে প্রায় প্রতিদিন পানি সেচ দিতে হতো। কিন্তু এবার সারা বছরই জিকে সেচের পানি পেয়েছি। এক লিটার তেলও কিনতে হয়নি। আর মাঠে ধানের চেহারা দেখলেই মন ভরে যাচ্ছে। এত সুন্দর ধান মাঠে হবে আশাই করতে পারিনি। তিনি আরও বলেন, এখন জমিতে সার ও বীজ আর নিড়ানি খরচ। পানি সেচ দিতে হয়নি। যার কারণে অর্ধেক খরচে এবার ধান হচ্ছে।
ফারুক আলী নামে আরেক চাষি বলেন, আমরা ঠিকমতো পানি সেচ পেতাম না বলে অনেকেই বোরো আবাদ কমিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার সারাবছর জিকে ক্যানেলের পানি পেয়েছি। এতে আমরা খুবই কম খরচে আবাদ করছি। আগামীতে ধানের আবাদ আরও বাড়বে।
ধান চাষি কামাল উদ্দিন জানান, বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার বোরো ধানের অবস্থা বেশ ভালো। সারাবছর পানি সেচ পাওয়ায় আউস ও আমন ধানের ফলন ভালো হয়েছিল। আমরা আশা করছি, এবার বোরো ধানেও বাম্পার ফলন হবে। এমন ভালো বোরো ধান গত ১০ বছরেও এ অঞ্চলে হয়নি।
তিনি আরও বলেন, অনেক কৃষক আবার বোরো আবাদে ফিরে আসছেন। খরচ বেশি হতো বলে বোরো আবাদ কম হতো। কিন্তু এবার পানি সেচ লাগছে না, তাই আবার বাড়ছে ধানের আবাদ। এদিকে কৃষি বিভাগ বলছে, এ বছর কুষ্টিয়ায় বেড়েছে বোরো ধানের আবাদ। যা আগের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ৩৫ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে আবাদ হয়েছে ৩৫ হাজার ২১৫ হেক্টর জমিতে। এছাড়া উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিলে ১ লাখ ৫৪ হাজার ৪৭৮ টন। এ বছর ফলন বেশ ভালো হওয়ার আশা রয়েছে কৃষি বিভাগের।
সেই সঙ্গে গত আউস ও আমন ধানেরও লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আবাদ করেন কৃষকরা। আউসে ২৮ হাজার ১১০ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল কৃষি অফিস। সেখানে কৃষকরা চাষ করেন ২৮ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে। আমনে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৮ হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমিতে। সেখানে আবাদ হয়েছে ৮৮ হাজার ৯০৫ হেক্টর জমিতে।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রমেশ চন্দ্র ঘোষ জানান, বোরো ধানের জমিতে সেচ খরচ বেশি হওয়ার কারণে বোরো চাষে কৃষকদের আগ্রহ ছিল না। তবে এ বছর আবার কৃষকরা বোরো ধান চাষে ঝুঁকছেন। মিরপুর উপজেলার অধিকাংশ কৃষি জমি জিকে সেচ প্রকল্পের পানি সেচে ধানের আবাদ হয়। যার ফলে কম খরচে ধানের আবাদ করছেন কৃষকরা।
এছাড়া উপজেলা কৃষি অফিস থেকে এ বছর বোরো মৌসুমে এক হাজার ৩০০ কৃষককে উচ্চ ফলনশীল (উফশী) এবং চার হাজার ৮৩০ জন কৃষকের মধ্যে হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ প্রণোদনার মাধ্যমে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এ বছর আবহাওয়া ধান চাষের জন্য অনুকূলে ছিল। আর আউস ও আমন ধানের মতো বোরো মৌসুমেও বাম্পার ফলন হবে বলে আমরা আশা করি।
কুষ্টিয়া জিকে সেচ পাম্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান জানান, বোরো মৌসুমে পাম্পগুলো সচল থাকায় আমরা কৃষকদের পর্যাপ্ত সেচ সুবিধা দিয়েছি। ৩৭ হাজার হর্স পাওয়ার ক্ষমতার পাম্পটির মাধ্যমে বোরো মৌসুমে সেকেন্ডে ১ হাজার ৩০০ কিউসেক পানি নদী উত্তোলন করা হচ্ছে। যদি ১০-১৫ বছর পর-পর পাম্পগুলোকে সার্ভিসিং করা হয়, তাহলে দীর্ঘস্থায়ীভাবে সেচ সুবিধা দেয়া সম্ভব। আশা করছি, আগামীতেও সারা বছর কৃষকদের সেচ সুবিধা দেয়া হবে, যাতে ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।
কুষ্টিয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সুশান্ত কুমার প্রামাণিক জানান, আমরা অল্প জমিতে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অধিক ফলনের জন্য কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় ধানের ফলন ও দাম ভালো হওয়ায় কৃষকরা ধান চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। সেই সঙ্গে প্রণোদনা ও নানা কর্মসূচির মাধ্যমে ধান চাষ বৃদ্ধিতে আমরা কাজ করছি।