কুষ্টিয়ায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক। তারা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল ও আদ্বদীন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
গতকাল সোমবার (৫ আগস্ট) বিকেলের দিকে থানাপাড়ায় ও মজমপুর এলাকায় এসব ঘটনা ঘটে। আহতরা কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
নিহতরা হলেন- কুষ্টিয়া সদর উপজেলার হরিপুর এলাকার নওশের আলীর ছেলে বাবু ইসলাম (৩৫), একই এলাকার কফিলউদ্দিনের ছেলে আশরাফুল ইসলাম(৪২), কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকার লোকমানের ছেলে আবদুল্লাহ (১৪), ইউসুফ আলী (৫০), দহকুলা এলাকার ওসামা (২৬), বাকি দুজন অজ্ঞাত।
গতকাল সোমবার দুপুরে কুষ্টিয়া মডেল থানা ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ গুলি চালালে এ হতাহতের ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুরের দিকে শহরের মজমপুর রেলগেট এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া হয়। এ সময় পুলিশ কয়েক দফা কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে। বেলা দেড়টার পর আন্দোলনকারীদের অপর একটি অংশ কুষ্টিয়া মডেল থানায় হামলা চালায়।
এসময় পুলিশ প্রথমে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ফাঁকা গুলি ছুড়ে আন্দোলনকারীদের হটাতে ব্যর্থ হয়। পরে আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি করা শুরু করে। পুলিশের মুহুর্মুহু গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেলের শব্দে থানার আশপাশের এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতেও আন্দোলনকারীরা পিছু হটেননি।
খবর পেয়ে সেনাসদস্যরা এসে মডেল থানার সব পুলিশ সদস্যকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান। এর পরপরই আন্দোলনকারীরা থানার ভবনে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে থানার ভেতরের সব আসবাব, জরুরি রেকর্ডসহ অন্যান্য দ্রব্য পুড়ে যায়। এ ছাড়া ভবনের সামনে থাকা ৮-১০টি মোটরসাইকেল ও একটি প্রাইভেট কার পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পরে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে বেলা দুইটার পর আন্দোলনকারীদের আরেকটি অংশ কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনসে ঢুকে পড়ে ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও শটগানের গুলি চালায়। এতে অনেক মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা সাতজনকে মৃত ঘোষণা করেন।
হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ ব্যক্তিদের চিকিৎসায় রক্তের জন্য হাহাকার চলছে। হতাহত ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে।
কুষ্টিয়ার সমন্বয়ক তুষার আহমেদ তুহিন জানান, সোমবার বিকেলের দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষুব্ধরা থানাপাড়ার মোড় ও মজমপুর মোড়ে অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় আন্দোলনকারীদের পুলিশ রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুড়তে থাকে। পুলিশের গুলিতে থানাপাড়ায় ঘটনাস্থলেই তিনজন মারা গেছেন। পরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও চারজন মারা যান। এ ঘটনায় দুই শতাধিক আন্দোলনকারী আহত হয়েছেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ তদন্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে সোমবার সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন জায়গায় আন্দোলনকারী ও পুলিশের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। কুষ্টিয়া শহরের থানার মোড়, মজমপুর, সাদ্দাম বাজার, এনএস রোড়, ছয় রাস্তার মোড়, পাঁচ রাস্তার মোড়সহ বিভিন্ন এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। বিকেলের দিকে মজমপুর ও থানাপাড়ায় আন্দোলনকারীদের গুলি করে পুলিশ। এতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীসহ ৭ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় দুই শতাধিক।
এর আগে আন্দোলনকারীরা কুষ্টিয়া ট্রাফিক অফিস, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক আজগর আলীর বাড়ী, পৌরসভা ভাংচুর চালায় এবং সড়কের বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বালিয়ে পুলিশকে লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন।
পুলিশ ধাওয়া ও রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করলে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন অলিগলিতে আশ্রয় নেন। বিকেলের দিকে পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে পুলিশ লাইনসে চলে যায়। পুলিশ পিছু হটলে আন্দোলনকারীরা থানায় হামলা করে। থানা কার্যালয়, ওসির বাসভবন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে এলে তিনজনকে মৃত ঘোষণা করেন জরুরি বিভাগের দায়িত্বরত চিকিৎসক। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও চারজন মারা গেছেন। মোট সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসাধীন বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি তাইজাল আলী খান, সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মানব চাকী, কুষ্টিয়া–২ আসনের সংসদ সদস্য কামারুল আরেফিনসহ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা–কর্মীদের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়েছে।
আওয়ামী সমর্থকদের কয়েকটি দোকানে লুটপাট হয়েছে। এ ছাড়া কুষ্টিয়া শহরের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও ভাস্কর্য এস্কেভেটর দিয়ে গুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ জনতা।