আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এআই প্রস্তুতি সূচকে ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম৷ ডিজিটাল অবকাঠামো, মানবপুঁজি ও শ্রমবাজার নীতি, উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক একীকরণ, নিয়ন্ত্রণ ও নীতি- এই চারটি ভিত্তির ওপর সূচক তৈরি করা হয়েছে৷
এই সূচকে বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া৷ আর কেনিয়া, রুয়ান্ডা, ঘানা, সেনেগালের মতো আফ্রিকার দেশগুলোও এই সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে৷ এআইয়ের প্রস্তুতির সূচকে শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর৷
এই সূচক প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, এটা আসলে এআই ব্যবহারের অবস্থা নয়, প্রস্তুতির সূচক৷ এটা করা হয়েছে যাতে দেশগুলো তাদের পলিসি ও প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত নিতে পারে৷ এখানে অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ, শ্রম আইন- এসব বিষয় তারা বিবেচনায় নিয়েছে৷ তাতে স্পষ্ট যে এআইর জন্য যে মানবসম্পদ দরকার সেই দিকে আমাদের উদ্যোগ তেমন নাই৷
আইএমএফ বলছে এআই উৎপাদনশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আয় বাড়াতে পারে৷ অনেক লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে৷ তবে এটা বৈষম্যও বাড়াতে পারে, কাজও হারাতে পারেন অনেকে৷
আইএমএফের গবেষণা অনুযায়ী এআই উন্নত অর্থনীতির দেশের ৩৩ শতাংশ, উদীয়মান অর্থনীতির দেশের ২৪ শতাংশ ও নিম্ন আয়ের দেশে ১৮ শতাংশ চাকরিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে৷ অন্যদিকে এআই বিদ্যমান চাকরির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে আসছে৷
ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, চাকরি হারানোর ঝুঁকি যেমন আছে তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও হবে৷ আর তার জন্য প্রয়োজন হবে উচ্চ দক্ষতা৷
‘৫০০-র বেশি প্রতিষ্ঠান এআই নিয়ে কাজ করছে’
বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে এআই এর ব্যবহার বাড়ছে৷ বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ খাত, মোবাইল ব্যাংকিং, মার্কেটিং৷ কৃষি খাতেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে জানান এআই নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান টেক গার্লিক এর প্রধান নির্বাহী পরাগ ওবায়েদ৷
তিনি জানান, বাংলাদেশে এখন ৫০০-র বেশি প্রতিষ্ঠান আছে যারা এআই এবং মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করে৷ তবে প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করেন এরকম মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ লাখ৷ বাংলাদেশে ২০০৮-৯ সাল থেকে এআই নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয় বলে জানান তিনি৷
পরাগ ওবায়েদ বলেন, মোবাইল ফোন কোম্পানি, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অনেক কর্পোরেট হাউজ এখন এআই টেকনোলজির সুবিধা নিচ্ছে৷ বাংলাদেশের কৃষিখাতেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে৷
তার মতে, বাংলাদেশের সব খাতেই এআই এর সম্ভাবনা আছে৷ বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে এআই এর ব্যবহার অনেক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে বলে মনে করেন ওবায়েদ৷
তিনি বলেন, আমাদের এখানে যারা কাজ করেন তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই প্রযুক্তি আয়ত্ত করছেন৷ প্রতিদিনই এটা পরিবর্তন হয়৷ অর্থাৎ এটা একটা সার্বক্ষণিক শিখন প্রক্রিয়া৷ দক্ষতা ও প্রচণ্ড আগ্রহ না থাকলে এটা সম্ভব নয়৷ আবার এই খাতে বিনিয়োগ করতে ব্যাংক ঋণও তেমন পাওয়া যায় না৷
‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার’
বন্ডস্টেইন টেকনোলজিস-এর কো-ফাউন্ডার শাহরুখ ইসলাম জানান, এখন মার্কেটিং-এ দেশীয় এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এআই ব্যবহার করছে৷ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পাচ্ছে৷ তবে আমাদের মাইন্ডসেটের এখনো তেমন পরিবর্তন আসেনি৷ আগে যখন কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় তখন চাকরি যাওয়ার ভয়ে অনেকে কম্পিউটার ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতো৷ এখনো আমরা দেখছি বিমান বাংলাদেশের ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার পরে কম্পিউটার বন্ধ করে রেখেছে৷ আসলে নতুন টেকনোলজিকে ওয়েলকাম করতে হবে৷
তার কথা, এজন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার৷ ভারত সরকার গত এপ্রিল মাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এআই কোম্পানির কাছে এক লাখ গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) অর্ডার করেছে৷ জিপিইউ হলো এআই-এর কাঁচামাল৷ আর আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগুলো ইউএসএ বা সিঙ্গাপুর থেকে আনি৷ আমাদের প্রচুর ডলার খরচ হয়৷ সরকার যদি একটা এআই সেন্টার করে জিপিইউ এনে আমাদের কাছে ভাড়া দেয় তাহলে আমরা উদ্যোক্তারা লাভবান হবো৷
‘আর এআই কোনো স্পর্শযোগ্য পণ্য বা বস্তু নয়৷ বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এই পণ্য উৎপাদনের জন্য ঋণ দেয় না৷ তারা দেয় হার্ডওয়্যারের জন্য৷ ফলে আমরা ঋণ পাই না৷ আমাদের নানাভাবে অর্থ জোগাড় করতে হয়৷ সরকারের এটা দেখা দরকার,’ বলেন বন্ডস্টেইন টেকনোলজিস এর শাহরুখ ইসলাম৷
তারপরও বাংলাদেশের সাত-আটটি প্রতিষ্ঠান এখন দেশের বাইরেও এআই সলিউশন দিচ্ছে বলে জানান তিনি৷
বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স এন্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সেঁজুতি রহমান বলেন, আমরা আসলে এখনো এআই প্রযুক্তির জন্য প্রস্তুত নই৷ আমরা এখনো ডিজিটাল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি৷ আমাদের প্রযুক্তির তৃতীয় যুগে যেতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত তরুণ লাগবে৷ সেই ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই, প্রতিষ্ঠান নেই৷ আবার যারা তৈরি হচ্ছে তাদের আমরা ধরে রাখতে পারছি না, তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে৷ তাদের ধরে রাখার ব্যবস্থা যেমন করতে হবে৷ তেমনি এআই আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষায় যুক্ত করতে হবে৷
তার কথা, আমাদের পাশের দেশে এআই নিয়ে অনেক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকে সরকার নানাভাবে সহায়তা করছে৷ কিন্তু আমাদের এখানে হচ্ছে না৷ তরুণ গবেষকদের ফান্ড দিতে হবে৷
অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন বলেন, মনে রাখতে হবে ওয়েবসাইটের ডিজাইন তৈরির দক্ষতা আর এআই এর দক্ষতা এক নয়৷ ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য শর্ট টার্মে কিছু প্রশিক্ষণ দিলেই হতো৷ কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব নয়৷ আমাদের টেকনোলজি তৈরি করতে হবে৷ সেই দক্ষতা লাগবে৷
তার মতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি হলো তাকে যে তথ্য দিয়ে রেডি করা হবে সে সেই ভাবে বিশ্লেষণ করবে৷ তার চিন্তা মানুষের মতো না৷ ফলে তাকে দিয়ে গুজব ছড়ানো বা একপেশে বিশ্লেষণ করানো সম্ভব৷
ড. সেঁজুতি রহমান বলেন, অ্যামাজন তাদের একটি টেকনিক্যাল রিক্রুটমেন্টের সিভি বাছাইয়ের জন্য মানুষের পরিবর্তে এইআইকে দায়িত্ব দেয়৷ তখন দেখা গেলো শুরুতেই এআই সব নারীর সিভি বাদ দিয়ে দেয়৷ আসলে তাকে যেভাবে প্রশিক্ষিত করা হয় সে সেইভাবে ফল দেয়৷ সুতরাং এআই ব্যবহারের নানা ঝুঁকিও আছে৷ সেটা অবশ্য নির্ভর করে মানুষের ওপর৷ আমরা কীভাবে ব্যবহার করতে চাই৷ এটা ক্ষতিকর কাজেও ব্যবহার করা যায়৷
আইন তৈরির উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার এরইমধ্যে এআই নিয়ে একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে৷ খসড়া আইনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে৷
বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইন অবশ্যই এর অপব্যবহার রোধে প্রয়োজন৷ একই সঙ্গে এআই এর জন্য অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ, প্রযুক্তিগত সহায়তা অনেক বেশি প্রয়োজন৷
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বুধবার আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল অডিটোরিয়ামে সরকারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক জিপিটি প্ল্যাটফর্ম জি-ব্রেইন-এর উদ্বোধন করেছেন৷ স্টার্টআপ জিপিটি, কনস্টিটিউশন জিপিটি ও বাজেট জিপিটি এই তিনটি ফিচার নিয়ে উদ্বোধন করা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক সরকারের জিপিটি প্ল্যাটফর্ম৷ তিনি সেখানে জানান, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আইনের খসড়া আসছে৷