বর্তমান প্রযুক্তি বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গবেষণা, ব্যবহার এবং এ খাতে বিনিয়োগের গুরুত্ব বাড়ছে। কম্পিউটার বিজ্ঞানের একটি অনন্য শাখা হচ্ছে এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যাতে মানুষের চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিমত্তাকে কম্পিউটার সফটওয়্যার দ্বারা অনুকরণ ও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও চিন্তাশক্তিকে কৃত্রিম উপায়ে প্রযুক্তিনির্ভর করে যন্ত্রের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) হলো মেশিন দ্বারা প্রদর্শিত বুদ্ধি। আন্দ্রেয়ার কাপলান এবং মাইকেল হেনলিন আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বলেন, ‘এটি একটি সিস্টেমের বহির্ভূত তথ্য সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারার ক্ষমতা, এমন তথ্য থেকে শিক্ষাগ্রহণ এবং ওই শিক্ষা ব্যবহার করে নমনীয় অভিযোজনের মাধ্যমে বিশেষ লক্ষ্য করা।’ ধারণা করা হয়, কৃত্রিম মানবযন্ত্র আবিষ্কারের চিন্তার সূত্রপাত হয় সম্ভবত রামন লোল’র মাধ্যমে ১৩০০ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯২০ সালের দিকে ‘রুশম’স ইউনিভার্সেল রোবটস’ নামে একটি সায়েন্স ফিকশন থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
জন ম্যাকার্থি সর্বপ্রথম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নামক টার্মটি ব্যবহার করেন ১৯৫৫ সালে। ১৯৫৬ সালে ডার্টমাউথ কলেজের এক কর্মশালায় প্রথম এআই গবেষণা ক্ষেত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গণিতবিদ অ্যালান টুরিংকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কর্তা বলা হলেও জন ম্যাকার্থিই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অন্যতম জনক। টুরিং-এর গবেষণার ‘চার্চ-টুরিং থিসিস’ থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার গোড়াপত্তন।
১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এআই গবেষণার জন্য ব্যাপকভাবে তহবিল প্রদান এবং বিশ্বব্যাপী এর গবেষণা গুরুত্ব পায়। ১৯৮০’র দশকের শুরুতে এআই গবেষণা বিশেষজ্ঞ সিস্টেমের বাণিজ্যিক সাফল্য দ্বারা পুনরুজ্জীবিত হয়। ১৯৮৫ সাল নাগাদ এআইয়ের বাজার এক বিলিয়ন ডলারের বেশি পৌঁছেছিল। একই সময়ে, জাপানের পঞ্চম প্রজন্মের কম্পিউটার প্রকল্প আমেরিকা এবং ব্রিটিশ সরকারকে একাডেমিক গবেষণার জন্য অর্থায়নে ফিরিয়ে আনতে অনুপ্রাণিত করেছিল। ২০১০-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত, সারা পৃথিবীতে মেশিন লার্নিং অ্যাপ্লিকেশনগুলো ব্যবহার করা হতো।
জ্যাক ক্লার্কের মতে, ২০১৫ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য একটি মাইলফলকের বছর ছিল, গুগলের মধ্যে এআই ব্যবহার করার জন্য সফটওয়্যার প্রকল্পগুলোর সংখ্যা ২০১২ সালে ২৭০০-এরও বেশি প্রকল্পে ‘স্পোরাইডিক ব্যবহার’ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে আইবিএম’র তৈরিকৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ‘ডিপ-ব্লু’ দাবা খেলায় খ্যাতিমান গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দেয়। ২০১০ সালে গুগলের আলফাগো গো খেলায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে পাঁচবারের মধ্যে চারবার হারিয়ে দেয়।
বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনেক নামকরা প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ করে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পত্রিকা ফরচুনের তথ্যমতে, প্রায় পাঁচশ নামকরা প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। প্রথাগত পরিবহণ ব্যবস্থাকে হটিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমতার বদৌলতে স্বয়ংক্রিয় পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তোল সম্ভব। সাইবর্গ টেকনোলজি যান্ত্রিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা মস্তিষ্ক দ্বারা চালিত হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রোবট বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সমাধানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম। কৃত্রিম বুদ্ধিসম্পন্ন রোবট হবে বন্ধুভাবাপন্ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বয়োবৃদ্ধদের উন্নত পরিচর্যায় ব্যবহৃত হবে।
জানা যায়, জাপানে ইতোমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন সংবাদমাধ্যম কোম্পানি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানীর অভিমত, আগামী ১২০ বছরের মধ্যে মানুষ তাদের সব কাজ বুদ্ধিমান মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে পারবে। স্টাম্পফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের দাবি, তাদের তৈরি করা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহজেই শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা করে মানুষের মৃত্যু কবে হবে, সেটা গণনা করে বলে দেবে। ৫০টিরও বেশি দেশ যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য রোবট তৈরি করছে-যেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ করবে এবং শত্রুকে মোকাবিলা বা হত্যা করার মতো কাজগুলো করবে।
বর্তমানে এ ধরনের রোবট এবং ড্রোনের গবেষণায় প্রচুর অর্থও ব্যয় করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রোবট ২০৫০ সালের মধ্যে সব মানবিক কাজ সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করতে পারবে রোবট। শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে নানা ব্যবসায়িক কাজে এর ব্যবহার বাড়ছে। এর বাইরে বেশি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হচ্ছে প্রতিরক্ষা।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মতে, নতুন প্রযুক্তির কারণে বিশ্বে ১৩ কোটিরও বেশি কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। ডাটা অ্যানালিস্ট, সফটওয়্যার ডেভেলপার, সোশ্যাল মিডিয়া স্পেশালিস্ট এ ধরনের কাজের ক্ষেত্র তৈরি হবে। এ ছাড়া শিক্ষক বা কাস্টমার সার্ভিস কর্মীর মতো কাজ, যাতে কিনা অনেক সুস্পষ্ট মানবিক গুণাবলির দরকার, সেরকম অনেক কাজও করতে সক্ষম হবে যন্ত্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এনভিডিয়া তৈরি করছে উন্নত চিপসেট। দ্রুত বাড়ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজার। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউবিএস জানাচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এআই খাতের রাজস্ব ২০ শতাংশ বেড়ে ৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়াবে। ইতোমধ্যে অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, অ্যালফাবেট এ বাজারের সুবিধা পেতে শুরু করেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে সন বলেন, ‘আমি মনে করি, আজ থেকে ৩০ বছর পরে বিশ্বে স্মার্ট রোবটের সংখ্যা হবে ১০ বিলিয়ন। এ রোবটরা ব্যাপকভাবে মানুষের চাকরি নিয়ে নেবে। যতগুলো শিল্প মানুষ গড়ে তুলেছে, সবগুলোই নতুন করে পুনর্বিন্যস্ত হবে।’
প্রযুক্তির উৎকর্ষের মাইলফলক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচকতার পাশাপাশি নেতিবাচকতাও রয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম’ জানিয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে রোবটের কারণে বিশ্বজুড়ে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ চাকরি হারাবে। ইলন মাস্ক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়নকে ‘দৈত্যকে ডেকে আনার শামিল’ আখ্যায়িত করে এটাকে মানবজাতির জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হুমকি হিসাবে অভিহিত করেছেন।’ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেছেন, ‘এরা এক সময়ে আমাদের অতিক্রম করে যাবে। এর ফলে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে।’
গুগলের প্রধান নির্বাহী সুন্দর পিচাই সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার রুখতে নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে চলা। আর কীভাবে প্রযুক্তির অপব্যবহার হতে পারে, তা নিয়ে আগেই ভাবা উচিত। শুধু নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও উন্নয়ন করলেই চলবে না, সে প্রযুক্তির ব্যবহার যেন মানবসভ্যতার বিপক্ষে না যায়, সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে।’ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরিতে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম ব্যবহারের পর যখন অকেজো হয়ে পড়বে সেসব বর্জ্যে পরিবেশের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ হিসাবে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণমূলক তদারকি জোরদার করতে হবে। মোটকথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচক ব্যবহার কঠোরভাবে রোধ করে এর ইতিবাচক ব্যবহার নিশ্চিত করতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।