ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের তালশার জি,টি ডিগ্রি কলেজের দুই শিক্ষক ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারি অধ্যপক মোঃ আব্বাস আলী ও যুক্তিবিদ্যা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক কাজী মোঃ মোফাজ্জেল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিনব কায়দায় জালিয়াতি, অনিয়ম ও ভূয়া সনদের মাধ্যমে পদোন্নতির অভিযোগ উঠেছে। এরই মধ্যে অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে (মাউশি) মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগ পত্র দাখিল করেছে শিক্ষকের একাংশ।
যার পরিপেক্ষিতে শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক বার কারন দর্শানোর চিঠি দেওয়া হলেও এখনো পর্যন্ত কলেজ কর্তৃপক্ষ নেয়নি কোন ব্যবস্থা। এমনকি অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে ভূয়া সনদ দাখিল করে পদোন্নতিদের বিরুদ্ধে একই কলেজের সমাজ বিজ্ঞানের প্রভাষক আব্দুল ওয়াহেদ বাদল বাদী হয়ে যুগ্ন জেলা দায়রা জজ আদালতে মামলা করেন।
যে মামলার কার্যক্রম এখনো আদালতে চলমান আছে। এদিকে মামলার বাদীকে নানা ভাবে করা হচ্ছে হয়রানি। এমনকি দেওয়া হচ্ছে প্রাণ নাশের হুমকি। যার পরিপেক্ষিতে বাদী আব্দুল ওয়াহেদ কোটচাঁদপুর থানায় ২০২০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর একটি সাধারণ ডায়েরী (জিডি) করেন। যার নং-৭০৪। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের মাধ্যমে সঠিক তদন্ত পূর্বক ব্যবস্থা গ্রহনের আশা ভুক্তভোগী ও সাধারণ শিক্ষকদের।
অভিযোগ সূত্রে জানাযায়, ২০০০ সালে কোটচাঁদপুর উপজেলার তালশার জি,টি ডিগ্রি কলেজ স্থাপিত হয়। পরবর্তিতে ২০০৪ সালের মে মাসে কলেজটি এমপিও লাভ করেন। এরই মধ্যে ২০০২ সালের ১১ এপ্রিল যুক্তিবিদ্যা বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান অভিযুক্ত শিক্ষক কাজী মোঃ মোফাজ্জেল হোসেন। একই তারিখে ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ পায় মোঃ আব্বাস আলী। জি,টি ডিগ্রি কলেজের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বিভাগের প্রভাষক পদে ২০০২ সালে নিয়োগ প্রাপ্ত হন আব্দুস সালাম। জানাযায়, জনবল কাঠামো নির্দেশিকা ২০১০ (মার্চ ২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) অনুচ্ছেদ ১১(৪) অনুযায়ী এম.পিও ভূক্ত প্রভাষকগণ প্রভাষক পদে এম,পিও ভূক্তি বা ক্ষেত্র বিশেষ যোগদানের তারিখ হতে ৮ বছর পূর্তিতে ৫:২ অনুপাতে সহকারী পদে পদোন্নতি পাবেন।
জি,টি ডিগ্রি কলেজ ২০০৪ সালের ১ মে এম,পিও ভূক্ত লাভ করেন। ফলে ২০১২ সালের ১ মে কলেজটির এমপিও’র ৮বছর পূর্তি হয়। মাউশির জনবল কাঠামো নির্দেশিকা অনুযায়ী সহকারী পদে পদোন্নতির জন্য কলেজের তৎকালিন গর্ভনিং বডির সভাপতি মোছাঃ শরিফুন্নেছা মিকি স্বাক্ষরিত জিটিডিক-২৭২(০৭)/১২ স্বারকে প্রভাষক পদে থাকা ৫ জনের নাম উল্ল্যেখ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে প্রেরণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়। কিন্তু তৎকালিন অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক অর্থের বিনিময়ে ষড়যন্ত্র করে গর্ভনিং বডির সিদ্ধান্ত তোয়াক্কা না করে ২৭২ নম্বর স্বারক পত্রের ক্রমনূসারে তৃতীয় স্থানে থাকা সহকারী অধ্যাপক পদে পদন্নোতি প্রাপ্তির জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক (৩০০২৩৩১ইনডেক্সধারী) আব্দুস সালামের নাম বাদ দেন। পরবর্তিতে গর্ভনিং বডির সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে জালিয়াতির মাধ্যমে কাজী মোফাজ্জেল হোসেনের (প্রভাষক) নাম উল্ল্যেখ করে একটি নতুন তালিকা তৈরী করে ২০-০৬-২০১২ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) দাখিল করে পদোন্নতির ব্যবস্থা করেন তৎকালিন অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক।
পরে জৈষ্ঠ্যতায় সহকারী অধ্যাপক পদে পদন্নোতির জন্য তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়টি জানতে চান আব্দুস সালাম। এসময় জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া শিক্ষক কাজী মোঃ মোফাজ্জেল হোসেন কারণ হিসাবে জনবল কাঠামো নির্দেশিকা অনুযায়ী ১৮-১১-২০১২ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) সহকারী পরিচালক মোঃ জসিম উদ্দিন স্বাক্ষরিত ৫৬০৩ নম্বর স্বারকের একটি আপত্তি নামা তুলে ধরেন। যাতে বলা হয়েছে সহকারী অধ্যাপক পদে পদন্নোতি প্রাপ্তির জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক আব্দুস সালামের নিয়োগ কালীন সময়ে মাস্টার্স পাশ ছিল না। অথচ যেই অভিযোগের ভিত্তিতে তালিকা থেকে আব্দুস সালামের নাম বাদ দিয়ে কাজী মোঃ মোফাজ্জেল হোসেনের নাম তালিকায় অর্ন্তভূক্তি করা হয়েছে, সেই শিক্ষকের নিয়োগকালীন সময়ে মাস্টার্স পাশ ছিল না।
এমনকি মাস্টার্স সনদ অনুযায়ী ০৭-০১-২০১৩ তারিখে সদন অর্জন করেন। কিন্তু তার মার্কশীর্ট অুনযায়ী ০৮-১০-২০০১ তারিখে মাস্টার্স সনদ অর্জন করেছেন। অন্যদিকে কাগজ পত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায় জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত শিক্ষক আব্বাস আলী ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষা বর্ষে অর্নাস পাশ করেন। আবার একই সালে ১৯৯৫-৯৬ শিক্ষা বর্ষেই মাস্টার্স পাশ করেছেন। একই শিক্ষা বর্ষের বিষয়টি কলেজের গর্ভনিং বডির নজরে আসলে অভিযুক্ত আব্বাস আলী ২৩-০২-২০১৫ সালে ১৯৯৮-৯৯ শিক্ষা বর্ষের নতুন আরো একটি মাস্টার্সের সনদ দাখিল করেন। ঘটনার কিছু দিন পরেই জি,টি ডিগ্রি কলেজের তৎকালীন গর্ভনিং বডির সভাপতি শরিফুন্নেছা মিকি সহ সংশ্লিষ্ট সকলে বিষয়টি জানতে পারেন। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলে অবাস্তব এবং অসম্ভব আখ্যা দিয়ে বলেন, ২০১২ এর ১৩ ধারা লংঘন করে ভূয়া কাগজপত্র দাখিল করে সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নিত পেয়েছেন অভিযুক্ত দুই শিক্ষক আব্বাস আলী ও কাজী মোফাজ্জেল হোসেন।
এদিকে জৈষ্ঠ্যতার বিচারে সহকারী অধ্যাপক পদে এপি স্কেল প্রাপ্তির জন্য প্রভাষক আব্দুস সালাম সুপ্রিম কোর্টের দারস্থ্য হয়ে ০২-০৬-২০১৫ তারিখে একটি মামলা দায়ের করেন। এমনকি তালিকা থেকে নিজের নাম বাদ দেওয়ার বিষয়ে জানতে ০৪-০৪-২০১৬ তারিখে তথ্য কমিশনের সহকারী পরিচালক (প্রচার ও প্রকাশনা) বরাবর ৬৭১ নং ডকেট নথিতে প্রয়োজনীয় তথ্য চেয়েও একটি আবেদন করেন। এই মামলার বিষয়ে জানতে পেরে তৎকালীন অধ্যক্ষ আব্দুল খালেকের উপস্থিতিতে মামলার বাদী আব্দুস সালামকে একটি কক্ষে জিম্মি করে অভিযুক্ত দুই শিক্ষক মোঃ আব্বাস আলী ও কাজী মোঃ মোফাজ্জেল হোসেন আব্দুস সালামের নিকট থেকে আপোস-মিমাংশার স্বাক্ষর করে নেন। এর পরেই আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে শুরু করেন নতুন ষড়যন্ত্র। বিছাতে থাকেন জালিয়াতির নতুন জাল।
অনুসন্ধানে দেখাযায়, ২৪-০৮-২০১৬ তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (কলেজ-৩) মোঃ হেলাল উদ্দিন স্বাক্ষরিত ৩০৩৬ নং স্বারকে আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে কলেজ পরিচালনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও অধ্যক্ষের বরাবর কারণ দর্শানোর একটি ভূয়া চিঠি ইস্যু করেন অভিযুক্ত দুই শিক্ষক। চিঠিতে বলা হয়েছে জি,টি ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক (৩০০২৩৩১ইনডেক্সধারী) আব্দুস সালামের নিয়োগ কালীন সময়ে মাস্টার্স পাশ না থাকায় জনবল কাঠামো মোতাবেক তাহার নিয়োগ বৈধ নয়।
যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় তাহার নাম এমপিও শীপ হতে কেন কর্তন করা হবে না মর্মে কারন দর্শানোর জবাব দিতে বলা হয়। এঘটনায় শিক্ষক আব্দুস সালামের দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে অভিযুক্ত শিক্ষক মোঃ আব্বাস আলী ডিজি অফিসের নাম ভাঙ্গিয়ে ১ লক্ষ টাকা দাবি করেন। এবং সেই টাকা তিনি (কলেজের দুই শিক্ষকের উপস্থিতিতে) আব্দুস সালামের নিকট থেকে হাতিয়ে নেন। এমনকি নিজেদের ক্ষোভ ও দূর্বলতার সুযোগে ভূক্তভোগী শিক্ষককে একের পর এক হয়রানী করে চলেছেন অভিযুক্ত দুই শিক্ষক আব্বাস আলী ও মোফাজ্জেল হোসেন। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ শিক্ষদের মাঝেও বাক-বিতন্ডা এমনকি হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে।
কলেজ ক্যাম্পাসে দুই শিক্ষকের দৌরাত্মে নাভিশ্বাস হয়ে পড়েছেন সাধারণ শিক্ষকরা। নাম প্রকাশ না করার সর্তে এক শিক্ষক বলেন, জি,টি ডিগ্রি কলেজে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে একক আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে জালিয়াতির মূল হোতা অভিযুক্ত দুই শিক্ষক আব্বাস আলী ও কাজী মোফাজ্জেল হোসেন।
ওই একই কলেজের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রভাষক মোঃ আসলাম হোসেনের বিরুদ্ধেও আছে সনদ জালিয়াতির অভিযোগ। নীতিমালা অনুযায়ী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে নিয়োগ পেতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর বগুড়া নট ট্রামর্স থেকে ৬ মাসের কোর্স সম্পন্নের সনদ থাকতে হবে।
কিন্তু প্রভাষক আসলাম হোসেন সেই সনদ ব্যবহার না করে স্থানীয় একটি (ঊষা) কম্পিউটার থেকে ক্রয়কৃত সার্টিফিকেট ব্যবহার করে তৎকালিন অধ্যক্ষ আব্দুল খালেকের যোগসাজশে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েছেন। এ বিষয়ে আসলাম হোসেনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাবেক প্রিন্সিপলের সাথে কথা বলতে বলেন। সাধারণ শিক্ষককে হয়রানি ও ভূয়া সনদে পদোন্নতির বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত দুই শিক্ষকের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অভিযুক্ত শিক্ষক মোফাজ্জেল হোসেন ভূয়া সনদের বিষয়ে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, এই সব বিষয়ে মোবাইলে বলা ঠিক হবে না। এসময় তিনি প্রতিবেদককে কলেজে আসতে বলেন।
অফিসাল বিষয়ে প্রতিষ্ঠানে বসে বলাই ভালো। সকল কাগজ পত্র এখানে আছে। বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘ দিন যাবত আদালতে মামলা চলছে বলেও জানান তিনি। অন্যদিকে অভিযুক্ত আর এক শিক্ষক আব্বাস আলীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি কি করি আপনি জানেন! নিজের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বলেন, অভিযোগ নিয়ে আমার অফিসে আসেন। বাসায় রেষ্ট করছি এখন কোন কথা বলতে পারবো না।
এ বিষয়ে কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল মোঃ রাশেদুল ইসলাম এর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি ভারপ্রাপ্ত হিসাবে দায়িত্বে আছি। এ সকল বিষয়ে সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক সাহেব বলতে পারবেন। এসময় তিনি প্রতিবেদককে মন্ত্রনালয় থেকে পাঠানো হয়েছে কিনা জানতে চান। জি,টি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক নিজের অনিয়ম ও জালিয়াতির বিষয়ে অস্বীকার করে বলেন, ২’শ ভাগ নিয়ম মেনেই ৬ জন শিক্ষকের পদোন্নতির তালিকা পাঠানো হয়েছিল। সেই তালিকায় ডিজি অফিস ৫ নং সিরিয়াল বাদ দিয়ে তালিকায় ৬ নম্বরে থাকা কাজী মোফাজ্জেল হোসেনকে পদোন্নতি দেন। কলেজের রেজুলেশন বইতে সেই তালিকা আছে। এবিষয়ে ডিজি অফিস ভালো বলতে পারবে।