কোরবানির ঈদকে ঘিরে সক্রিয় হয়ে উঠেছে জাল নোট কারবারিরা। সারা বছরই এ চক্র কাজ করে। তবে দুই ঈদে বেশি সক্রিয় থাকে। বিশেষ করে কোরবানির পশুর হাটের মৌসুমি ব্যাপারীরা এ চক্রের হাতে প্রতারিত হন। এছাড়া অন্যান্য ক্রেতা-বিক্রেতা তো আছেনই। গত এক মাসেই প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া গত দেড় বছরে প্রায় ১৭ হাজার জাল নোট ধরা পড়েছে। যা টাকার অঙ্কে প্রায় দেড় কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত ১৯ মাসে সারা দেশে প্রায় ৬ কোটি টাকার জাল নোট ধরা পড়েছে।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বছরে প্রত্যেক ব্যাংকে গড়ে ৪০০-৫০০টি জাল নোট ধরা পড়ে। আমি যখন এমডি ছিলাম তখন এমন চিত্র ছিল। এখন কমবেশি হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৮ মাসে (২০১৯ ও ২০২০ সালের ছয় মাস) ১৬ হাজার ৯৯১টি জাল নোট ধরা পড়েছে। যার পরিমাণ ১ কোটি ৪১ লাখ ৫৫ হাজার ৭৫০ টাকা। এর মধ্যে এক হাজার টাকার জাল নোটই রয়েছে ১২ হাজার ৪৫০টি। টাকার অঙ্কে যা ১ কোটি ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এছাড়া ৫০০ টাকার ৩ হাজার ৩১৮টি বা ১৬ লাখ ৫৯ হাজার টাকা, ১০০ টাকার ১৫৩টি নোট বা ১৫ হাজার ৩০০ টাকা এবং ৫০ টাকার ৬২৯টি নোট বা ৩১ হাজার ৪৫০ টাকা ধরা পড়ে। চলতি বছরের মাত্র ৬ মাসে (জানুয়ারি-জুন পর্যন্ত) ১ হাজার ২৩১টি জাল নোট ধরা পড়ে। এর মধ্যে ১ হাজার টাকার নোটই ৭৪৯টি। বাকিগুলো ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট। এ সময় ৪৮টি ঘটনায় মামলা করা হয়। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০১৯ সালে ১৫ হাজার ৭৬০টি জাল নোট ধরা পড়ে। যার ১১ হাজার ৭০১টিই ১ হাজার টাকার নোট। বাকিগুলো ৫০০, ১০০ ও ৫০ টাকার নোট ছিল। এ সময় মামলা করা হয় ১৭৫টি।
এদিকে গত এক মাসেই সাড়ে ৪ কোটি টাকার জাল নোট উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৮ জুলাই পুরান ঢাকার বংশাল ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৩৫ লাখ টাকার জাল নোট এবং তা তৈরির বিভিন্ন উপকরণসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার আগে ৩০ জুন মিরপুর ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার দুটি বাসা থেকে ৪ কোটি টাকার জাল নোটসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করেছিল র্যাব। এছাড়া ২০ জুলাই রাজধানীর বড় মগবাজার ও ২৩ জুলাই টাঙ্গাইল সদর উপজেলার করটিয়া পূর্বপাড়া থেকে বিপুল পরিমাণ জাল টাকা উদ্ধার করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, গত দুই দশকে সারা দেশে জাল নোট সংক্রান্ত মামলা হয়েছে ৮ হাজার ৩৬৬টি। অনেক মামলা নিষ্পত্তি হলেও এখনও ২ হাজারের বেশি মামলা তদন্তাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জাল নোটের মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাক্ষী আদালতে আসেন না। আবার এলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীরা দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করেন। এতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন তারা। এক পর্যায়ে আসামি পার পেয়ে আবারও একই অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।
সূত্র জানায়, ‘জাল মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ আইন, ২০২০’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এই খসড়ার ওপর এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অংশীজনের মতামত নিচ্ছে। খসড়া আইনে শাস্তির বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যত বেশি নকল মুদ্রা তৈরি বা সরবরাহের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, তার দণ্ড তত বেশি হবে। যে কোনো মূল্যের ১০০টির কম জাল মুদ্রা পাওয়া গেলে দুই বছর কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হবে। এতে বলা হয়েছে, জাল মুদ্রা প্রস্তুত, ধারণ, বহন, সরবরাহ, আমদানি-রফতানি এবং মুদ্রা প্রস্তুতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিসহ আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদি সম্পর্কে তথ্য দিলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সরকার থেকে পুরস্কৃত করা হবে।
আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এখন থেকে জাল নোট বিষয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান মামলা করতে পারবে। এতদিন শুধু পুলিশ জাল মুদ্রার মামলা করতে পারত। আবার কারও কাছে জাল মুদ্রা থাকলেই তার বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না। ওই জাল মুদ্রার বাহক আত্মপক্ষ সমর্থন বা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের সুযোগ পাবেন। বাহক যদি প্রমাণ করতে পারেন যে, তিনি সরল বিশ্বাসে ওই মুদ্রা বহন এবং বৈধ লেনদেনের অংশ হিসেবে ধারণ করেছেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হবে না। তবে জাল মুদ্রার বাহক কোথা থেকে তা পেয়েছেন, তা প্রমাণ করতে হবে। অবশ্যই এক্ষেত্রে জাল মুদ্রার সংখ্যা দশ পিসের কম হতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, এতদিন সিভিল পেনাল কোড অনুযায়ী জাল নোটের অপরাধীদের বিচার হতো। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল যার কাছে জাল নোট পাওয়া যেত, তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হতো। এজন্য প্রস্তাবিত আইনে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা হয়েছে। সূত্র-যুগান্তর