অডিও ক্লিপ ভাইরাল : পর্ব—১
সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রী মোনালিসা গত ১০ বছরে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছেন বলে খোদ স্বীকার করেছেন তার ছোট ভাই সরফরাজ হোসেন মৃদুল। গতকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি অডিও ক্লিপে এ তথ্য দিয়েছেন তিনি। অনলাইন ক্যাসিনো সম্রাজ্ঞী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন মন্ত্রী পত্নী মোনালিসা হোসেনকে। মন্ত্রী দম্পত্তি গত ১০ বছরে মেহেরপুরের অনলাইন ক্যাসিনো থেকে শুরু করে এমন কোন খাত নেই যেখানে দুনীর্তি করেননি। আর এসকল কর্মকাণ্ড করে গড়েছেন বিপুল সম্পদের মালিক। কানাডায় বাড়ি কিনেছেন বলে এতদিন ধরে যে খবর রটেছিলো সেই খবরের সত্যতা স্বীকার করলেন তারই ছোট ভাই মেহেরপুর জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহবায়ক সরফরাজ হোসেন মৃদুল। শুধু কানাডায়ই না বিভিন্ন যায়গায় বাড়ি কিনেছেন বলে স্বীকার করেছেন। তবে অডিও ক্লিপে অপর প্রান্তে কে কথা বলছেন তা জানা যায়নি। হতে পারে কোন গোয়েন্দা কর্মকর্তা অথবা সাংবাদিক।
অডিও ক্লিপে মুজিবনগর উপজেলা চেয়ারম্যান আমাম হোসেন মিলূ, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সালাম বাধন, আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম খোকন এরা সকলেই অনলাইন ক্যাসিনোর সাথে জড়িত ছিলেন। অনলাইন ক্যাসিনোর এজেন্টরা মৃদুল, বাঁধন, খোকন ও মোনালিসা সাথে সখ্যতা তৈরি করে মেহেরপুরকে অনলাইন ক্যাসিনোর স্বর্গরাজ্যতে পরিণত করেছিলেন, যার প্রভাব এখনো বিদ্যামান। মন্ত্রী দম্পত্তির সুপারিশে অনলাইন জুয়ার মূল হোতারা সবসময় আইন শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যায়।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আসেন মেহেরপুরে। বসন্তের কোকিল হয়ে প্রবেশ করেন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। একতরফা ওই নির্বাচনে মেহেরপুর—১ আসনে জয়ী হয়ে পরের বছর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ পেয়ে যান। এরপর ধীরে ধীরে মেহেরপুরে দলীয় রাজনীতি থেকে শুরু করে উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি পর্যন্ত সবই চলে যায় ফরহাদ হোসেনের পরিবারের দখলে।
আওয়ামী লীগের নেতা—কর্মীরা বলছেন, পরিবারের সদস্য, স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের দলীয় বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন (দোদুল)। তাঁদের অনেককে জনপ্রতিনিধিও বানিয়েছেন। তাঁদের দিয়েই জেলার ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। বিপরীতে কোণঠাসা করেছেন দলের ত্যাগী নেতাদের। তাঁর বিপক্ষে গেলে দলীয় নেতা—কর্মীদের নানাভাবে নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। ফরহাদের ভাই ও ভগ্নিপতির দাপটে দলীয় নেতা—কর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা তটস্থ থাকতেন।
কলেজশিক্ষক থেকে মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের বাবা ছহিউদ্দীন বিশ্বাস ছিলেন মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি। তবে সংসদ সদস্য (এমপি) হওয়ার আগপর্যন্ত দলে কোনো পদ ছিল না ফরহাদের। এলাকায় সজ্জন হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের চাচাতো বোন সৈয়দা মোনালিসা ইসলামকে বিয়ে করেন। ২০১৪ সালে মেহেরপুর—১ আসনের এমপি হওয়ার পর ২০১৫ সালের অক্টোবরে সরাসরি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বনে যান। সবশেষ ২০২২ সালেও দলের সম্মেলনে তিনি একই পদ পান। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ফরহাদ হোসেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালে তৃতীয়বারের মতো এমপি হয়ে এক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে ছিলেন ফরহাদ হোসেন ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় মেহেরপুরে সাবেক এই মন্ত্রীর বাসভবনের সামনের গাড়ি রাখার টিনের ছাউনি ভেঙে আগুন ধরিয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ফরহাদ হোসেনের ‘ব্যক্তিগত কার্যালয়ে’ ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে শহরের বড়বাজার সড়কে পৌর কমিউনিটি হলের সামনে ফরহাদ হোসেনের ছোট ভাই জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সরফরাজ হোসেনের বাণিজ্যিক তিনতলা ভবনের নিচতলার একটি দোকান পুড়িয়ে দেয় উত্তেজিত জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজধানীর আদাবর থানার পোশাককর্মী রুবেল হত্যা মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর রাতে ফরহাদ হোসেনকে রাজধানীর ইস্কাটন থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। বর্তমানে তিনি কারাগারে।
ফরহাদ হোসেন এমপি হওয়ার আগ পর্যন্ত এলাকার মানুষ প্যারাসিটামল বিক্রেতা হিসেবে চিনত সরফরাজ হোসেন মৃদুলকে। পৌরসভার পাশে ছোট একটি ফার্মেসীর দোকান ছিল তার। ভাই ২০১৪ সালে এমপি হওয়ার পরপরই তিনি ঠিকাদারি ব্যবসায় যুক্ত হন। প্রভাব বিস্তার করে দরপত্র বাগিয়ে নিতেন। এরপর তিনি পৌরসভা কমিউনিটির সামনে বড় বাজার সড়কের পাশে ৬ কাটা জমি কিনে বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেন।
মেহেরপুরের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের উন্নয়নকাজের ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করতেন ফরহাদ হোসেনের ভগ্নিপতি বাবলু বিশ্বাস ও ভাই সরফরাজ হোসেন। মূলত অন্যদের প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ নিয়ে বাবলু বিশ্বাস তা নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে জানিয়েছেন ঠিকাদারেরা।
গত বছরের ২০ অক্টোবর সরফরাজ হোসেনের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার চেক প্রত্যাখ্যানের (ডিজঅনার) মামলা করেছেন দেবাশীষ বাগচি নামের এক ব্যক্তি। একসময় তিনি সরফরাজের ব্যবসায়িক অংশীদার ছিলেন। তিনি বলেন, ২০১৫ সাল থেকে তিনি সরফরাজের সঙ্গে যৌথভাবে ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত গণপূর্ত, জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রকৌশলী, এলজিইডিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩৫টি দরপত্র তিনি প্রভাব খাটিয়ে বাগিয়ে নেন। এর আনুমানিক মূল্য ২৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালে জানুয়ারিতে সরফরাজ হঠাৎ কিছু না বলে তাঁকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে বের করে দেন। পাওয়া টাকা চাইলে পুলিশ দিয়ে হয়রানি শুরু করেন। একপর্যায়ে পাওনা টাকা বাবদ গত বছরের ১২ জুলাই ১ কোটি ৮০ লাখ টাকার একটি চেক দেন। কিন্তু পরে দেখা গেছে, ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই। পরে আদালতে মামলা করেন।
মেহেরপুর সরকারি বালিকা ও বালক উচ্চবিদ্যালয়ে দুটি ছয়তলাবিশিষ্ট একাডেমি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। প্রতিটি ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় কোটি টাকা। বালিকা বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ঠিকাদার বাবলু বিশ্বাস, বালক বিদ্যালয়টির ঠিকাদার সরফরাজ হোসেন। পাশাপাশি অবস্থিত বিদ্যালয় দুটির শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকেদের অভিযোগ, তাঁরা বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ দখল করে ভবন নির্মাণের সামগ্রী রেখেছিলেন। বালক বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক ফজলুল হক বলেন, ‘একাডেমি ভবন নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সদ্য সাবেক জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের ভগ্নিপতি আবদুস সামাদ বাবলু বিশ্বাস। তাঁকে মাঠ পরিষ্কার রাখতে নির্মাণসামগ্রী সরিয়ে নিতে বলার ক্ষমতা আমাদের ছিল না।’
অডিও ক্লিপে আওয়ামী লীগ নেতাদের মামলা থেকে মুক্তি দেওয়ার নামে জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুন ও তার ভাই অ্যাডভোকেট মারুফ আহমেদ বিজন কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন বলে অভিযুক্ত করেন সরফরাজ হোসেন মৃদুল। এর আগেও মাসুদ অরুন টাকা নিয়ে সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রীকে ভারতে পার করে দিয়েছেন বলে গুজব উঠেছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে ঢাকা থেকে র্যাব ফরাহদ হোসেনকে আটক করে।
ফলে অধিকতর যাচাই বাছাইয়ের জন্য সংশ্লিষ্টরা তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য বেরিয়ে আসবে।
তবে অডিও ক্লিপে অভিযুক্ত করা জেলা বিএনপির সভাপতি মাসুদ অরুনকে মেহেরপুর প্রতিদিন থেকে ফোন করা হলে তিনি বলেন, এর আগেও গুজব তোলা হয়েছিলো। এখনও গুজব তোলা হচ্ছে। তবে অডিওতে একজন কাউকে অভিযুক্ত করলেই সে অভিযুক্ত হয়ে গেলো না। বিষয়টি যাচাই বাছাই করার আহবান জানান তিনি।
মেহেরপুর প্রতিদিনও এই অডিও ক্লিপের সত্যতা যাচাই বাছাই করে পরবর্তি পর্ব (অডিও ক্লিপের বাকি অংশ) প্রকাশ করবে।