রাজধানীর মিরপুর-১৪ নম্বর এলাকার ঢাকা ডেন্টাল কলেজ থেকে কচুক্ষেত এলাকায় যেতে সড়কের উভয় পাশে আটটি ব্যাংকের উপস্থিতি রয়েছে। এর মধ্যে একই জায়গায় দুদিকে সাতটি। এক পাশে সোনালী, ডাচ্–বাংলা ও প্রাইম ব্যাংকের ইব্রাহিমপুর এবং ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সেনানিবাস শাখা। অপর পাশে আইএফআইসি, প্রিমিয়ার ও ইস্টার্ণ ব্যাংকের (ইবিএল) উপশাখা।
শাখাগুলো বেশ পুরোনো হলেও উপশাখাগুলো খোলা হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। এর মধ্যে আইএফআইসি ব্যাংকের উপশাখাটি চালু হয় গত বছরের জুলাইয়ে। সেটিতে গিয়ে দুজন কর্মকর্তা, একজন কর্মচারী ও একজন নিরাপত্তা প্রহরী দেখা গেল। উপশাখাটি এ পর্যন্ত ১০ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। তবে ঋণ দিয়েছে মাত্র ৭০ লাখ টাকা। এই উপশাখা আইএফআইসি ব্যাংকের মিরপুর শাখার অধীন। মিরপুর শাখার অধীনে এ রকম আরও ছয়টি উপশাখা রয়েছে।
উপশাখাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোনিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের প্রায় সব ধরনের সেবা এখানে দেওয়া হয়। মানুষ অবশ্য বিভিন্ন বিল জমা দিতে বেশি আসছেন।’
জানতে চাইলে আইএফআইসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহ আলম সারওয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শহরে প্রতি তিন মাইল ও গ্রামে প্রতি পাঁচ মাইল পরপর আমাদের উপশাখা পৌঁছে যাবে। এসব উপশাখায় পূর্ণাঙ্গ শাখার মতো সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা মিলছে। এভাবে আমরা এক কোটি পরিবারকে ব্যাংকিং সেবায় যুক্ত করতে চাই। সে জন্য প্রযুক্তি, ব্যবসায়িক মডেল ও মানবসম্পদে বড় বিনিয়োগ করা হয়েছে।
শহরে প্রতি তিন মাইল ও গ্রামে প্রতি পাঁচ মাইল পরপর আমাদের উপশাখা পৌঁছে যাবে। এসব উপশাখায় পূর্ণাঙ্গ শাখার মতো সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা মিলছে।
বিভিন্ন ব্যাংকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তারা এখন অর্থ খরচ করে বৃহৎ পরিসরে শাখা খোলার পরিবর্তে উপশাখা চালুর দিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। শুধু রাজধানীতে নয়, সারা দেশেই তা করা হচ্ছে।এভাবে সবার কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে উপশাখা চালু করেছে ৩৬টি ব্যাংক। আগে যা ব্যাংকিং বুথ নামে পরিচিত ছিল, তা-ই এখন উপশাখা। এতে কম খরচে ব্যাংকিং সেবা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। বদৌলতে তৈরি হচ্ছে নতুন গ্রাহক, বাড়ছে আমানত। এতে ব্যাংকিং সেবা দেওয়ার নতুন সম্ভাবনা হয়ে উঠছে উপশাখা। একই সঙ্গে উপশাখাগুলো আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অগ্রগতিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেবে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও বিশ্লেষকেরা। তবে তাঁরা বলছেন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতে উপশাখার মাধ্যমে ঋণ বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং বুথ স্থাপনসংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে। বলা হয়, ব্যাংকিং বুথের আয়তন হবে এক হাজার বর্গফুটের মধ্যে। এরপরই ব্যাংকগুলো বুথ স্থাপন জোরদার করে। আর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং বুথের নাম পাল্টে উপশাখা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলো পরিচালিত হচ্ছে ব্যাংকের নিকটবর্তী শাখার অধীনে। উপশাখায় বৈদেশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম ছাড়া আমানত সংগ্রহ ও ঋণ বিতরণ কার্যক্রমসহ সব ধরনের ব্যাংকিং সেবা পাওয়া যায়।
এ কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে, যাতে পুরো দেশ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আসে। তবে গ্রাম থেকে পাওয়া আমানতের পুরো টাকা শহরে বিতরণ করা যাবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোর মোট উপশাখা ছিল ৩৯৩টি, যা ২০২০ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে হয় ১ হাজার ১৪৭টি। চলতি বছরের জুনে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৬৭২টি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৫০০টি উপশাখা হচ্ছে বেসরকারি খাতের আইএফআইসি ব্যাংকের। পরের অবস্থানে রয়েছে এনআরবি কমার্শিয়াল (এনআরবিসি) ব্যাংক। নতুন প্রজন্মের এই ব্যাংকের রয়েছে ৩৯৩টি উপশাখা। উল্লেখযোগ্য অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ১৯৪টি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ৮৮টি ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) ৭৯টি উপশাখা রয়েছে।
অন্য ব্যাংকগুলোর মধ্যে ইউসিবির ৬০টি, এমটিবির ৩২টি, পূবালীর ৩০টি, যমুনার ৩০টি, ওয়ানের ২৭টি, গ্লোবাল ইসলামির ২৭টি, ইউনিয়নের ২৩টি ও সাউথইস্টের ২টি উপশাখা রয়েছে। এদিকে বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি এখন সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোও উপশাখা খুলতে শুরু করেছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, উপশাখার মাধ্যমে মূলত ব্যাংকে আসে না এ রকম আমানত সংগ্রহে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। কিছু ব্যাংক তাদের উপশাখাগুলোকে আমানত সংগ্রহের লক্ষ্যও বেঁধে দিয়েছে। তবে ঋণের ক্ষেত্রে তা করেনি। তাই উপশাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সবাইকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগের পাশাপাশি উপশাখা খোলায় জোর দেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা মানুষের বাড়ির পাশে পৌঁছে যাচ্ছে। উপশাখার মাধ্যমে ঋণ দেওয়ারও অনুমতি রয়েছে। ব্যাংকগুলো কেন উপশাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বাড়াচ্ছে না, তা বুঝতে পারছি না।’
উপশাখা হলো ব্যাংকের শাখার আদলে ছোট পরিসরের ব্যবসাকেন্দ্র। কম খরচে আর্থিক সেবা দিতে একটি শাখার অধীনে কয়েকটি উপশাখা কাজ করে। উপশাখায় সর্বোচ্চ ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। তবে কোনো কোনো উপশাখা মাত্র দুজন কর্মকর্তা দিয়ে চালাতেও দেখা যায়। কম লোকবল নিয়োগ দেওয়ায় এবং সাজসজ্জা কম করায় উপশাখার পেছনে খরচ কম হয়।
ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সেবার মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠী সেবার আওতায় আসছে। এই কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে, যাতে পুরো দেশ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আসে। তবে গ্রাম থেকে পাওয়া আমানতের পুরো টাকা শহরে বিতরণ করা যাবে না। এতে আঞ্চলিক বৈষম্য আরও প্রকট হবে। ব্যাংকগুলোকে উপশাখার মাধ্যমে ঋণ বিতরণ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে।