একটা ছোট্ট শিশু পৃথিবীর কোনোকিছু বোঝে না, জানে না। তার লালন-পালনের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে তার মা-বাবা। ফলে একজন মা কিংবা বাবার কিন্তু কিছু প্রিলিমিনারি জ্ঞান থাকা প্রয়োজন শিশুর লালন-পালন সম্পর্কে এবং অতি অবশ্যই শিশুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে।
আমি কোনোভাবেই বলব না এই মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ বা ডেডিকেশানের কোনো অভাব ছিল; তবে খুব সম্ভবত জ্ঞান বা সচেতনতার অভাব ছিল। যদিও জীবন-মৃত্যু সবকিছু আল্লাহর ইশারায় হয়, তবুও বোধহয় তিনি নিজেকে কিছুটা অপরাধী ভাববেন।
আসলে ঘটনাটি কী হয়েছে? সবার বোঝার জন্যে খুব সিম্পলিফাই করে বলা যাক। ওরাল রিহাইড্রেশান সল্টের (যাকে পানিতে মেশানোর পর আমরা স্যালাইন বলছি) মধ্যে থাকে লবণ অর্থাৎ সোডিয়াম ক্লোরাইড, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, থাকে গ্লুকোজ এবং ট্রাইসোডিয়াম সাইট্রেট৷ নিয়ম হচ্ছে আমাদের যে স্যালাইনের প্যাকেটটি পাওয়া যায় তা হাফ লিটার পানির মধ্যে মিশিয়ে খাওয়তে হয়।
এখন কেউ যদি এর চেয়ে অল্প পানিতে স্যালাইন মিশিয়ে খাওয়ায় তাহলে কী হবে? শরীরে লবণের মাত্রা বেড়ে যাবে অনেক বেশি।
এর প্রভাবে কোষ থেকে পানি বেরিয়ে আসবে, বিশেষ করে ব্রেইনের। কোষগুলো নষ্ট হবে। এবং তা থেকে মৃত্যু হওয়া অস্বাভাবিক না৷ যেমনটি হয়েছে এই শিশুর ক্ষেত্রে। সোডিয়াম ক্লোরাইড রক্তে থাকার কথা ১৩৫-১৪৫ মিলিমোল/লিটার, সেখানে শিশুটির হয়ে গিয়েছিল ১৬৫ মিলিমোল/লিটার! তার মা না কি একটু একটু করে সল্ট নিয়ে একটু একটু করে পানিতে মেশাচ্ছিলেন৷ ফলে লবণ পানির যে রেশিওটি মেইন্টেইন করার কথা ছিল তা সম্ভব হয়নি।
প্রশ্ন : তাহলে স্যালাইন কীভাবে বানাতে হবে?
উত্তর : হাফ লিটার পানি নিতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় হাফ লিটারের একটা বোতল দিয়ে মেপে নিলে। এবার পুরো প্যাকেটটির সবটুকু ঢেলে দিয়ে মিশিয়ে নিতে হবে৷ এরপর পরিমাণমতো খাওয়াতে হবে।
প্রশ্ন : কী ধরনের পানির সঙ্গে মিশাবো? ডিসটিলড ওয়াটার না কি আমরা যে পানি খাই সেটা?
উত্তর : আমরা নিয়মিত যে পানি পান করি সেটাই ব্যবহার করব; ডিসটিলড ওয়াটার না। কারণ সে পানিতে বেশ কিছু মিনারেল আছে। ডায়রিয়ার সঙ্গে মিনারেল বেরিয়ে যায় শরীর থেকে।
প্রশ্ন : একটু একটু করে সল্ট পানির সাথে মেশালে হবে না?
উত্তর : না, হবে না। লবণের তুলনায় পানি কম-বেশি হয়ে উপরের কেইসের মতো ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনতে পারে। তাই পুরোটা একসাথেই বানাতে হবে।
প্রশ্ন : স্যালাইন বানিয়ে কতোক্ষণ রাখা যাবে?
উত্তর : ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত খাওয়ানো যাবে।
প্রশ্ন : ১২ ঘণ্টা পর স্যালাইন রয়ে গেলে সেটা কী করব?
উত্তর : ফেলে দিতে হবে।
প্রশ্ন : টাকা দিয়ে কিনেছি নষ্ট কেন করব?
উত্তর : এটা নষ্ট করা না। এর মধ্যে গ্লুকোজ থাকে। যে পানিতে গ্লুকোজ থাকে তা জীবাণু বেড়ে ওঠার জন্যে বিপজ্জনকভাবে কাজ করে। আর ১২ ঘণ্টা পর সেখানে জীবাণুর সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা খুব বেশি। এই স্যালাইন খাওয়ালে শরীরে জীবাণুর সংক্রমণ হতে পারে।
প্রশ্ন : গ্লুকোজ যখন খারাপই, তাহলে এখানে গ্লুকোজ দেবারই বা কী দরকার ছিল?
উত্তর : একটা মানুষের যখন বারবার লুজ স্টুল পাস হতে থাকে, সে শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এই গ্লুকোজ তাকে এনার্জি দেয়। তাছাড়া ডায়রিয়ার সময় প্রচুর লবণ বেরিয়ে যায় শরীর থেকে, এখন স্যালাইনের মধ্যে যে লবণ (সোডিয়াম) থাকে তা কোষের ভেতরে ঢোকাতে গ্লুকোজের সহায়তা লাগে।
প্রশ্ন : এতো যখন ঝামেলা তো স্যালাইন বারবার খাওয়াবার দরকার কী? শুনেছি বাজারে ইমোটিল নামে একটা ওষুধ পাওয়া যায় সেটা খেলে না কি ডায়রিয়া বন্ধ হয়ে যায়? সেটা খাইয়ে দিই?
উত্তর : না। ২০ বারের বেশি ডায়রিয়া হলে চিকিৎসকরা এটা দিয়ে থাকেন। তাছাড়া এই ওষুধটার কিছু সমস্যা আছে। ডায়রিয়ার সঙ্গে শরীরের বিষাক্ত পদার্থ/জীবাণুগুলো বেরিয়ে যায়, এখন আমরা যদি এই ওষুধ দিই তাহলে স্টুল পাস হওয়াই বন্ধ হয়ে যাবে৷ ফলে সেগুলো শরীর থেকে বের হবে না, যা ক্ষতিকর। এছাড়া ছোট বাচ্চাদের ক্ষুদ্রান্ত্রের মুভমেন্ট বন্ধ করে দিয়ে ‘প্যারালাইটিক আইলিয়াস’-এর মতো ভয়াবহ অবস্থা করতে পারে।
আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ নিন সবসময়। মনে রাখবেন আপনার চিকিৎসক আপনার আপনজন। কোনো চিকিৎসকই কোনোভাবেই চান না তার রোগী খারাপের দিকে যাক। এটা তার জন্যে গ্লানিকর। না জানা দোষের কিছু না, জানতে চেষ্টা না করা দোষের কিছু হবার সম্ভাবনা বেশি।
লেখক: ডা. মারুফ রায়হান খান
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে উচ্চতর ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত