বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় দুই মাস ধরে হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রায়ই তাকে সিসিইউতে নেওয়া হচ্ছে। তারা মনে করছেন, দেশের বাইরে নিয়ে চিকিৎসা দিলে তিনি সেরে উঠতে পারেন। যদিও আইনত তার এখন বিদেশে যাওয়ার সুযোগ নেই। যদি যেতেই হয় তাহলে আদালতের মাধ্যমে তাকে অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু সেই অনুমতি চাইতে হলে আগে কারাগারে ফিরতে হবে। কারণ ইতোমধ্যে তিনি একটি সুবিধা নিয়েই সাজাপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজ বাসায় অবস্থান করছেন।
এই জটিল পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের কোনও শর্ত মেনে বিদেশে যেতে নেতাদের রাজি হতে বারণ করে দিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসন। প্রশ্ন হলো, কেন তিনি শর্ত ছাড়া যেতে চান। বিএনপিইবা কেন বা কোন যুক্তিতে তাদের চেয়ারপারসেনকে বিনাশর্তে বিদেশে নিতে চান। শুরু থেকেই বিএনপির আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় স্পষ্ট বলে দেওয়া আছে, সরকার চাইলে তাকে মুক্তি দিতে পারে। বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ করে দিতে পারে।
যদি ধরেও নিই সরকার চাইলে পাঠাতে পারবে। কেনো পাঠাবে? বিএনপি কি সেই পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছে? বিএনপি কি খালেদা জিয়ার শারিরীক পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলাপে বসতে চেয়েছে? আদালতের বাইরে নির্বাহী আদেশে সরকার প্রধান প্রথম দফা খালেদা জিয়াকে নিজ বাসভবনে যেতে অনুমতি দিয়েছিলো। দ্বিতীয় দফাও সেভাবে কিছু করার সুযোগ সরকার কেনো নিবে? আদালতের বাইরে একাধিকবার এই পদ্ধতি অবলম্বন অন্য কারাবন্দিদের মানবাধিকার নিশ্চিত করে কি? বিএনপি নিশ্চয় একবারের জন্যও সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন না।
৪০১ ধারার ক্ষমতাবলেই নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে ২০২০ সালের মার্চে খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয় সরকার। নতুন আবেদনের বিষয়ে আইনমন্ত্রী জানান, একই আবেদন বারবার নিষ্পত্তির সুযোগ নেই। এটি একবারই নিষ্পত্তি হয়। ফলে খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হলে পুনরায় জেলে গিয়ে আদালতে আবেদন করতে হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ফৌজদারি কার্যধারার ৪০১ এর একটি উপধারা অনুযায়ী দুটি শর্তে তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নেয়ার যে অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো সে আদেশও তারা বাতিল করবেন না জানিয়েছেন। ফলে সরকারের যে নির্বাহী আদেশে মিসেস জিয়া শর্তসাপেক্ষে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন সেই আদেশ বাতিল না করলে তার আপাতত জেলেও ফেরত যাওয়ার সুযোগ নেই। এখন সরকার কোন জায়গা থেকে বিনাশর্তে তাকে বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করবে?
একজন সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে বিনাশর্তে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিলে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হতে পারে? তিনি চিকিৎসা শেষ করে ফিরবেন তার নিশ্চয়তা থাকে না। এর আগেও এমন বহু নজির আছে যারা অপরাধ করে দেশত্যাগ করেছেন এবং তাদের আর ফেরানো সম্ভব হয়নি। সরকারের সাথে আলাপকালে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার কথা উত্থাপিত হলে বিএনপি থেকে জানানো হয় জার্মানিতে যেতে চান তারা। সেখানে ইনটেনশনটা পরিস্কার হয়। তারা এমন জায়গায় যাওয়ার নিশ্চয়তা চান যাদের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তি বাংলাদেশের নেই।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত খুনি শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীর অবস্থান প্রাথমিকভাবে শনাক্ত হলেও তাদের ফেরত আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েও কোন উপায় বের করা যায়নি। নূর চৌধুরী কানাডায়, রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, শরিফুল হক ডালিম স্পেনে এবং মোসলেম উদ্দিন জার্মানিতে আছেন বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন। আর খুনি খন্দকার আবদুর রশীদ ও আবদুল মাজেদ কোথায় আছেন সেটা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায় না।
খালেদা জিয়ার সন্তান তারেক রহমান মুচলেকা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। এরপর তার বিরুদ্ধে করা মামলায় সাজা হলে তাকে ফেরানোর কথা ওঠে। কিন্তু লন্ডন থেকে তাকে ফেরানোর কোন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশে ফেরানো নিয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন জানান, তারেক যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রয়েছেন। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বন্দি বিনিময় চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে। মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিসটেন্স বা এক্সটাডিশন নিয়ে আমাদের বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল এখনো পাওয়া যায়নি।
এতগুলো উদাহরণ যখন সামনে আছে তখন বিনা শর্তে কেনো খালেদা জিয়াকে বিদেশে নিতে চান বিএনপি নেতারা তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা যদি তার মঙ্গল কামনা করতেন তাহলে অবশ্যই যে দেশেই চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো সেখানে নিতে চাইতেন। সেখানে চিকিৎসা করানোর সুযোগ পাওয়াটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য হতো। তারা শুরু থেকেই খালেদা জিয়ার চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে রাজনীতি করে এসেছে। সেখানে সরকারকে বিপদে ফেলার ইনটেনশন যতোটা ছিলো, খালেদা জিয়াকে সারিয়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা ততটো ছিলো কিনা সে প্রশ্ন করা এখন সময়ের দাবি।