গাংনীর তিন ডিলারের কারসাজিতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি (ভোজ্য তেল) সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে শহরে ১৫ টাকা আর গ্রামাঞ্চলে ২০ থেকে ২৫ টাকা। গাংনী শহরে মের্সাস সিদ্দিক ট্রেডার্স সিটি গ্রুপের তীর সয়াবিন, মেসার্স সেলিম ট্রেডার্স বসুন্ধরা গ্রুপের সয়াবিন তেল ও আতিয়ার ট্রেডার্স রুপ চাঁদা সয়বিন তেলের ডিলার।
তেলের দাম এক সপ্তাহের ব্যবধানে শহরে ১৫ টাকা আর গ্রামাঞ্চলের দোকানে ২০/২৫ টাকা বাড়লেও উপজেলা প্রশাসন জানে আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে। তবে, ডিলারদের সাথে কথা বলবেন বলে জানালেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী খানম। গাংনী উপজেলা শহর ও গ্রামাঞ্চলের তেলের বাজার ঘুরে বিভিন্ন ভোক্তা, খুচরা বিক্রেতা ও ডিলারদের সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে তেলের বাজারের চিত্র।
গাংনী উপজেলায় এখন দোকানগুলোতে খোলা তেল পাওয়া গেলেও কোম্পানীর বোতলজাত তেলের কোনো হুদিশ মিলছে না। খুচরা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, ডিলাররা বোতলজাত তেল কোম্পানীর কাছ থেকে এনে খুচরা পাইকারদের কাছে খোলা তেল বানিয়ে বিক্রি করছেন। এতে তারা ৫ লিটারের এক বোতল তেল ১০ টাকার পরিবর্তে ১০০ থেকে ১১০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করছেন। তারা বাজারে কৃতিম সংকট সৃষ্টি করেই এই অতিরিক্ত মুনাফা লুটছেন বলে জানিয়েছেন খুচরা পাইকার ব্যবসায়ীরা।
তবে সিটি গ্রুপের তীর সয়াবীন তেলের গাংনী উপজেলার ডিলার মের্সাস সিদ্দিক স্টোরের মালিক সিদ্দিকুর রহমান জানান, আমরা তেলের জন্য কোম্পানীকে ১০ লক্ষ টাকার ডিডি পাঠালে তারা আমাদের ৬ লাখ টাকার সয়বিন তেল দিচ্ছেন কোম্পানী। বাকী ৪ লাখ টাকার শরিষার তেল দিচ্ছেন তারা। এসব তেল পেতে আমাদের দেড় থেকে দুই থেকে মাস অপেক্ষা করা লাগে। তারপর তেল পাচ্ছি। এতে আমরা বেশ ক্ষতির মুখে পড়ছি। তারপরেও কোম্পানী আমাদের ৪ লক্ষ টাকার শরিষার তেলের দামও বেশী নিচ্ছেন। শরিষার প্রতি কেজি তেলের দাম ১০০ টাকা থাকলেও সেটা আমাদের কাছে এখন ১৬০ টাকা ধরে নিচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেছেন কোম্পানীই আমাদের সুযোগ বুঝে ব্যবহার করছেন।
তিনি আরো বলেছেন, কোম্পানীর বোতলজাত ৫ লিটার তেলের দাম ৭৪০ টাকা। বোতলজাত ৫ লিটার তেল বিক্রি করে মাত্র ১০ টাকা লাভ করতে পারেন পাইকার খুচরা দোকানদার। সেখানে তারা বোতল খুলে লুজ তেল হিসেবে বিক্রি করলে ৫ লিটার তেলের বোতলের দাম পাচ্ছেন ৮৬০ টাকা। প্রতি ৫ কেজি লুজ সয়াবিন তেলে করে বিক্রি করলে ১২০ টাকা অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে পারেন খুচরা ব্যবসায়ীরা।
গাংনী বাজারের খোলা তেলের ডিলার সুমন হোসেন জানান, আমরা মৌলভী বাজার থেকে তেলের ডিলারশীপ নিয়েছি। আমরা এখন তেলের ডিডি পাঠালেও তেল পেতে সময় লাগছে এক থেকে দেড় মাস। খোলা তেলের বাজার বাড়ার কারণ তিনি জানাতে পারেনি তিনি। গাংনী উপজেলায় এখন মারাত্বকভাবে সয়াবিন তেলের সংকট দেখা দিয়েছে। মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে সয়াবিনের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা।
মাত্র ১০ দিন আগে প্রতি কেজি খোলা সয়াবিন তেল বাজারে ছিল ১৬২ টাকা। এখন ১৬২ টাকার পরিবর্তে প্রতি কেজি সয়াবিন বিক্রি করছেন গাংনী উপজেলা শহরে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা এবং গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলোতে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা কেজি।
গতকাল শনিবার রাতে গাংনী উপজেলা শহর, জোড়পুকুরিয়া বাজার, তেরাইল, বামন্দী ও বাওট বাজারে ঘুরে এসব মূল্যে সয়াবিন তেল বিক্রি করা দেখা গেছে।
গাংনী উপজেলা শহরের মেসার্স বজলু ট্রেডাসের মালিক বজলুর রহমান জানান, বাজারে সয়াবিন তেল না থাকায় বাজারে সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা ডিলারদের কাছ থেকে যেভাবে পাচ্ছি সেভাবেই বিক্রি করছি। তিনি বলেন, বোতলজাত তেলের সংকট থাকায় ডিলারদের কাছ থেকে লুজ তেল নিয়েই বিক্রি করছি।
বাজারের কয়েকজন খুচরা পাইকার ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গাংনী উপজেলা শহরের তিন জন ডিলারের কাছে কয়েকদিন পর পর বোতলজাত তেলের গাড়ি আসলেও তারা আমাদের বোতলজাত তেল দিচ্ছেন না। বোতলজাত তেল নিয়ে এসে অধিক মুনাফা লাভের জন্যই লুজ করে আমাদের দিচ্ছেন। আমরা তো কোম্পানীর কাছ থেকে সরাসরি তেল কিনতে পারছিনা। তারা অভিযোগ করেন কোম্পানীর তিন ডিলারের কারসাজিতেই ব হঠাৎ সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের একেক জনের ৮/১০ টি গোডাউনে সয়াবিন তেলের মজুত থাকলেও তেলের কৃত্তিম সংকট সৃষ্টি করেছে বলে জানান তারা।
গাংনী শহরের সিনেমা হল পাড়া এলাকার আরজ আলী ও সাহাবুল ইসলাম জানান, বাজারে বোতলজাত তেল কেনার জন্য বেশ কয়েকটি দোকানে গেলেও বোতলজাত তেল পেলাম না। অথচ, প্রতিটি দোকানেই লুজ তেল আছে বলে জানালেন দোকানদরা। গত সপ্তাহে এক কেজি লুজ তেল ১৬২ টাকায় কিনলেও আজকে তেল কিনলাম ১৯২ টাকা কেজি।
জোড়পুকুরিয়া গ্রামের আব্বাছ আলী ও রোজিবুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন ক্রেতা জানান, আজকে লুজ সয়াবিন তেল কিনেছি ২০০ টাকা কেজি দরে। এক সপ্তাহ আগেও এই তেল কিনেছিলাম ১৭৪ টাকা কেজি দরে। একই কথা জানালেন, বাওট গ্রামের রবিউল ইসলাম, মহিদুল ইসলাম ও শাহিনুজ্জামান। তারা বলেন, বাজারে কোথাও বোতলজাত তেল পাওয়া যাচ্ছেনা। তবে, অতিরিক্ত মূল্যে খোলা সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে। প্রতি কেজি তেল গ্রামাঞ্চলের বাজারগুলোতে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে বলে জানান তারা।
হঠাৎ করে সয়াবিন তেলের মূল্য ১৭৫ থেকে ২০০ টাকায় বৃদ্ধি পাওয়ায় সাধারণ মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তবে, বোতলজাত সয়াবিন তেলের মূল্য প্রতি লিটার ১৬৮ টাকা, খোলা সয়াবিন ১৪৩ টাকা ও খোলা পাম ওয়েল ১৩৩ টাকা খুচরা মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে সরকারীভাবে। গাংনী বাজারের কাশেম ট্রেডার্স কে সয়াবিনের বাজার মূল্য জানতে ফোন করা হলে সয়াবিন তেল নেই বলে জানান।
সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধি সম্পর্কে গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী খানম মোবাইল ফোনে জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় হয়তোবা তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তিন ডিলারে কারসাজিতে তেলের দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন গাংনীর কোম্পানীর তিন ডিলারকে ডেকে বিষয়টি জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে কেউ সয়াবিন আটকিয়ে রেখে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে তা জানালে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবেন। ঘন্টায় ঘন্টায় সয়াবিন তেলের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তারপরও বাজার মূল্য কেমন চলছে তা জেনে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।