চাকরির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের এক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী আমরণ অনশন শুরু করেছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ঝিনাইদহ জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে তিনি এই অনশন শুরু করেন।
সরকার একটি চাকরির নিশ্চয়তা না দেওয়া পর্যন্ত তিনি এক ফোঁটা পানি পান করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার চত্ত্বরে একটা হ্যান্ড মাইকে তিনি তার আবেদন তুলে ধরেছেন। তিনি দাবি করেন, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চাকরির আবেদন করছেন কিন্তু প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে কোন চাকরি পাচ্ছেন না।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মেধাবী শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, চাকরি যদি নাই হবে তাহলে কেন সরকার লেখাপড়ার সুযোগ দিল।
তিনি সমাজসেবা অধিদপ্তরের কারিগরি প্রশিক্ষক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের টেলিফোন অপারেটর, বাংলাদেশ টেলিভিশনের টেলিফোন অপারেটর পদসহ কয়েক জায়গায় চাকরির পরীক্ষা দিয়েছেন।
শাহীন বলেন, আমি সমাজসেবা অধিদপ্তরের কারিগরি প্রশিক্ষকের পরীক্ষায় রিটেনে পাস করেছিলাম। এরপর বাদ পড়ে যাই। বাকিগুলোতে শ্রুতিলেখকের নানা সমস্যার কারণে ঠিকমতো পরীক্ষা দিতে পারিনি।
শাহিন আলম ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার আলমপুর গ্রামের কৃষক আবদুল কাদের ও মোছা. ফারা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান। করোনাকালীন দেশ বিদেশের ১১৩ জন শিক্ষার্থীকে অনলাইনে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দিয়ে সাড়া ফেলেন তিনি। অনলাইন মাধ্যমে এ প্রশিক্ষণ দিতে কারো কাছ থেকে কানাকড়িও নেননি তিনি।
নিজে একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী; প্রশিক্ষণও দেন দেশ-বিদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের। সে সময় দেশের গুরুত্বপূর্ণ গণমাধ্যমগুলো প্রতিবেদন প্রচার করলে আলোচনায় উঠে আসেন তিনি।
শাহিন জন্ম থেকে দৃষ্টিহীন ছিলেন না। আলমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় তার জ্বর হয়। ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়ে জ্বর সেরে গেল। কিন্তু ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি সম্পূর্ণ হারিয়ে গেল তার। তবুও থেমে থাকেনি পড়ালেখা।
অন্য ১০ জনের মতো পড়া লেখা করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে সে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হলেন স্থানীয় হাই স্কুলে। সমাজ সেবা অধিদপ্তরের সমন্বিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত নড়াইল তুলারামপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হন শাহিন। ২০১৩ সালে এসএসসি এবং ২০১৫ সালে ঝিনাইদহের মহেশপুর সামছুল হুদা খান মহাবিদ্যালয় থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
শাহিন আলমের স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। কিন্তু টাকার বড় অভাব। বন্ধুদের কাছ থেকে নোট সংগ্রহ করে অন্যকে দিয়ে পড়িয়ে অডিও রেকর্ড করে নেন। ওই রেকর্ড শুনে শুনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান করে নেন। ধার-দেনা করে ভর্তি হন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ব্রেইল পদ্ধতি ব্যবহার করে পড়ালেখা শুরু করেন তিনি। নিজস্ব কোনো কম্পিউটার ছিল না তার। অদম্য মেধাবী শাহিন বিশ্ববিদ্যালয়ের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রিসোর্স সেন্টারের কম্পিউটারে খণ্ডকালীন প্রশিক্ষণ শেষ করেন।
এরপর কম্পিউটার ব্যবহার করতে শুরু করেন। ধীরে ধীরে অনন্য এক দক্ষ কম্পিউটার ব্যবহারকারী হয়ে উঠেন তিনি। টিউশন ও বৃত্তির টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা চলতে থাকে তার। ২০১৯ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। মাস্টার্স শেষ করার অপেক্ষায় আছেন।
মহামারি করোনায় রাজধানী থেকে নিজ বাড়ি চলে আসেন। বাড়িতে বসে থেকে লাভ কী? কিছু একটা করতেই হবে তাকে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিনাপয়সায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদানের ঘোষণা দেন। করোনাকালীন দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু করার চিন্তা থেকে এ উদ্যোগ নেন শাহিন।