৮ ডিসেম্বর ২০১৯ সালে থেকে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান সিটিতে বসবাসরত লোকদের মধ্যে হঠাৎ করে ব্যতিক্রমী ধরনের নিউমোনিয়া তীব্র আকারে দেখা দেয়। এবং আক্রান্তদের অনেকেই খুব দ্রুত অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বিষয়টি সবাইকে হতচকিত করে দেয়।
নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, আক্রান্তদের অনেকেই ঐ সময়ে উহান সিটির হুয়ানান নামের একটি বাজারে সদাই-পাতি করতে গিয়েছেন। হোয়ানান বাজারের বিশেষত্ব হচ্ছে সেখানে সামুদ্রিক প্রাণির পাশাপাশি জীবন্ত হিংস্র জীবজন্তু যেমন শিয়াল কুকুর শাপ বাদুড় এসবের কাটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হয় দৈনন্দিন খাবারের জন্যে।
চীনাদের শিয়াল, কুকুর, ইঁদুর, চামচিকা, বিড়াল, বাদুড়, সাপ, ব্যাঙ, কেচু, বিচ্ছুসহ যাবতীয় সব হিংস্র প্রাণি প্রিয় খাবার। এসব খাদ্যাভ্যাস তাদের ঐতিহাসিক।
অনেকের ধারণা, প্রাচীনকালে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রায়ই ফসলহানি হতো এবং দুর্ভিক্ষ ও মহামারি লেগে থাকতো।
ধারণা করা হয়, এসব দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েই বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের মধ্যে এসব হিংস্র জীবজন্তু খাওয়ার খাদ্যাভ্যাস গড়ে উঠে, এবং কালক্রমে সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যায়।
যাইহোক এসকল আক্রান্ত রোগীদের জ্বরের বিশেষত্ব হলো, জ্বর হাঁচি কাশির সঙ্গে তাদের কারো কারো ছিলো তীব্র শ্বাসকষ্ট। এবং কেউ কেউ খুব দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে লাগলেন।
চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ রহস্যময় রোগের কারন উদঘাটনে মনোনিবেশ করে আক্রান্তদের সতর্কতার সাথে পরীক্ষানিরীক্ষা কাজ শুরু করলেন।
অবশেষে ৭ জানুয়ারি ২০২০ সালে চায়নিজ ডিজিজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন সেন্টার তাদের দেহে নতুন এক ভাইরাসের সন্ধান পান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই ভাইরাসটির নাম দেন ২০১৯nCoV বা ২০১৯ নোভেল করোনা ভাইরাস।
এ ভাইরাস হিংস্র জীবজন্তু থেকে মানুষকে সংক্রমণ করেছে এবং পরে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়েছে। এই নোভেল করোনা ভাইরাস মানুষ ও জীবজন্তুর উভয়ের শ্বাসযন্ত্রের তীব্র সংক্রমণ করে, এবং সেই সাথে দ্রুততম সময়ে মৃত্যু ডেকে আনে।
করোনাভাইরাস নিয়ে বিস্তারিত জানতে চায়নিজ চিকিৎসা গবেষক ৮ ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০২০ পর্যন্ত করোনাভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়ে উহান সিটির জিং ইং তান হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৯৯ জন রোগীর উপর একটি গবেষণা কার্যক্রম চালান।
আক্রান্ত ৯৯ জনের প্রত্যকের দেহে ২০১৯nCoV আর এন এ (RNA) ভাইরাস এর উপস্তিতি পাওয়া যায় রিয়েল টাইম পলিমারেজ চেইন রিএকশন (RT PCR) পদ্ধতিতে।
কীভাবে সংক্রমণ শুরু?
গবেষণায় দেখা যায়, এই ৯৯ জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের ৪৯ জন উহান সিটির সেই হোয়ানান জীবজন্তুর মার্কেটে গিয়েছিলেন। আক্রান্তদের বয়সের গড় ছিলো ৫৫’৫ বছর। যে ৪৯ জন হোয়ানান মার্কেটে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ৪৭ জন ঐ মার্কেট ঘন ঘন যাতায়াত করতেন ও সময় কাটাতেন বাকী ২ জন কদাচিৎ গিয়েছিলেন।
কারা বেশী আক্রান্ত হয়েছিলেন, পুরুষ না মহিলা?
আক্রান্ত ৯৯ জন রোগীর ৬৭ জন ছিলেন পুরুষ এবং ৩২ জন ছিলেন মহিলা।
করোনাভাইরাসে কি কি লক্ষণ দেখা যায়?
আক্রান্তদের লক্ষণগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৯৯ জন রোগীর মধ্যে ৮২ জনের ছিল তীব্র জ্বর, ৮১ জনের কাশি, ৩১ জনের শ্বাসকষ্ট। মাংসপেশিতে ব্যাথা ছিল ১১ জন, কনফিউশান ছিল ৯ জনের, মাথাব্যথা ও গলা ব্যাথা ছিল যথাক্রমে ৮ জন ও ৫ জনের। সর্দি ছিল ৪ জনের, বুকে ব্যাথা ও পাতলা পায়খানা ছিল ২ জনের এবং খাবার অরুচি ও বমি ছিল ১ জনের।
ভর্তি হওয়া রোগীর ৮০ জনের অধিক উপরোক্ত লক্ষণগুলোর একাধিক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
রক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা
ভর্তিকৃত রোগীর রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায়, তাদের ২৪ জনের লিউকোসাইট স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ৯ জনের স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম, এবং ৩৮ জনের রক্তে নিউট্রোফিলের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি। ১২ জনের প্লাটেলেট মাত্রা ছিল স্বাভাবিকের তুলনায় কম।
বুকের এক্সরে পরীক্ষা করে দেখা যায়, ৭৪ জনের ফুসফুসে ছিল তীব্র সংক্রমণ। এছাড়াও ৪৩ জনের লিভারের কর্মক্ষমতা ব্যাহত হয় এবং ৭ জনের কিডনির কর্মক্ষমতা মারাত্মক হ্রাস পায়।
কী কী চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল?
করোনাভাইরাস আক্রান্তদের এন্টিভাইরাস দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। এছাড়াও তাদের এক বা একাধিক এন্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড, ব্রংকো ডাইলেটর, এন্টিহিস্টামিন, জ্বর ও ব্যথানাশক এবং অক্সিজেন দেয়া হয়েছিল।
মৃত্যু হয় কতজনের?
করোনাভাইরাস আক্রান্ত ৯৯ জনের মধ্যে ৩১ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন, ১১ জন মৃত্যুবরণ করেন বাকি ৪৭ জন এখনো চিকিৎসা নিচ্ছেন।
কারা মারা গেলেন এবং কেন?
মারা যাওয়া সবার বয়স ছিলো ৪০ এর উপরে এবং তারমধ্যে ৫ জনের ছিল ৬০ এর অধিক। হাসপাতালে ভর্তির পর প্রথম যিনি মারা যান তার বয়স ছিলো ৬১ এবং তার দেহে পূর্বে কোন রোগ না থাকলেও তিনি ছিলেন অতিমাত্রায় ধুমপায়ী।
চীনের প্রস্তুতি
মৃত্যুর সম্ভাবনা প্রবল এবং দ্রুত থাকায় চীন ওই শহরকে সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি ভাবে বিচ্ছিন্ন (লক ডাউন) করে দেয় অধিবাসীদের অন্যান্য শহরে ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে দেয়। পুরো উহান সিটি ব্লক ডাউন করা সত্যেও নতুন এই করোনাভাইরাস চীন ছাড়াও বর্তমানে বিশ্বের ২৫ টি দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্যমতে (ফেব্রুয়ারি ২) করোনা ভাইরাস এ পর্যন্ত চীনে প্রায় ৩০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছেন ১৪৩০০ জন। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। চীনের বাহিরে ফিলিপাইনেও এক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে।
প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা?
নতুন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিককে চীন থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। দুদিন আগে বাংলাদেশের ৩১৬ জন যাত্রীকে বিশেষ ব্যবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং এদের মধ্যে ৭ জনকে সর্দি জ্বর থাকায় ঢাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা চলছে। বাকিদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
বর্তমানে চীনের সঙ্গে সবার ফ্লাইট বন্ধ রয়েছে। আমেরিকা তাদের নাগরিকদের চীন ভ্রমণে লেভেল-৪ (সর্বোচ্চ) সর্বোচ্চ নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
গত ২৩ শে জানুয়ারি ২০২০ তারিখে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা উহান করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবকে জনস্বাস্থ্য বিষয়ক জরুরি অবস্থা (গ্লোবাল ইমার্জেন্সি) ঘোষণা করেছে।
সুত্র-যুগান্তর