রফিকুল আলম:
চরম বিশ্বাসঘাতকার মধ্য দিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাত থেকে হারিয়েছিলাম বাঙলার স্বাধীনতার সূর্যটি। দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসন আর ২৩ বছরের পাকিস্তানের দুঃশাসনের পতন ঘটিয়ে সীমাহীন ত্যাগ আর বিসর্জনের বিনিময়ে বাঙলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে ফিরে পেলাম স্বপ্নের স্বাধীনতার সূর্য্যটি। সেতো এক সুদীর্ঘ বীরচিত ইতিহাসের সাক্ষী।
আমরা জানি ১৭৫৭ খ্রিষ্টব্দে বাঙালী জাতির স্বাধীনতার লাল সূর্য পলাশীর প্রান্তরে বৃটিশ আক্রমণকারীদের হাতে অপমানজনক পরাজয় বরণ করে অস্তমিত হয়েছিল। আর তখন থেকেই এ সাহসী জাতি স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিল। তাদের এই সুদীর্ঘ সংগ্রামের ফসল ঘরে তুলেছিল ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিলের এই দিনে, মেহেরপুর জেলার মুজিবনগরে। বাঙালী জাতি তাঁদের স্বাধীনতার লাল সবুজ পতাকা পূণরায় উত্তোলন করেছিল গ্রীষ্মের এই দিনে মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের নিভৃত পল্লী বৈদ্যনাথতলায়।
মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্যে ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ গভীর রাতে একটি জাতি এবং সার্বভৌম একটি দেশ পুণরায় জন্ম লাভ করেছিল। বাঙালী জাতির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিয়েছিল এই মুজিবনগরে। ইতিহাসের পাতায় অনেক দেশের স্বাধীনতার গল্প পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে কিন্তু নিজের সামনে একটা দেশের জন্ম দেখার অনুভূতি আমি ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। তখন আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। যাহোক আমরা ইতিহাসের দিকে চোখ ফিরায়।
অনেক জীবন, মা বোনের ইজ্জত সম্ভ্রম এবং এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছিল তার আসল পরিচয় ও বাস্তবতা। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ বাঙালী জাতির আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে সেই ১৮৮৫ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত অনেক ঘটনায় উল্লেখ করেছেন। বাঙলাদেশীদের স্বপ্ন চূড়ান্ত ভাবে বাস্তবায়িত হয়েছিল ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর আম বাগানে, যেখানে বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নিয়েছিল। সেখানে সেই মহতী অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশ ও বিদেশের সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদগণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে একটি রেডিও সেন্টার স্থাপন করে প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠান সারাদেশে সম্প্রচার করা হয়েছিল এবং মুজিবনগর সেদিন পেয়েছিল ঐতিহাসিক মর্যাদা।
মুসলিম এলাকায় মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করা হবে এই শর্তের মাধ্যমে ১৯০৫ সালেই রোপিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামক দেশটির বীজ। যার অংকুরোদ্গম হয়েছিল ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তথাকথিত মুসলিম মতবাদ। সামাজিক ভাবে ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশাল অসমতা সৃষ্টি করে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠি আমাদের শাসনের নামে শোষণ, নিপীড়ন ও বঞ্চিত করেছিল ।
ফলশ্রুতিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার নেতৃবৃন্দ এ কে ফজলুল হক, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাষানী, সহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালে ১১ দফা দাবী দিয়েছিলেন। দাবীর মধ্যে অন্যতম দাবী ছিল বাংলা ভাষা, ভূমিহীনদের মধ্যে ভুমি বন্টন, শিক্ষা জাতীয়করণ, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ সহ পূণর্বাসন, ২১ ফেব্রুয়ারীতে শহীদ দিবস পালন সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি প্রভৃতি। বাঙালী জাতির এই নৈতিক সাহসীকতা দেখে তখনই ভয় পেয়েছিল পাাকস্তানী শাসক গোষ্ঠী।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টিতে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের জয়যুক্ত করেছিল সাধারণ জনগণ। কিন্তু ক্ষমতা লোভী পাকিস্তানী শাসকরা নিয়মানুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।
২৫ মার্চ, ১৯৭১ এর সেই কালো রাত্রিতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার কিছু আগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা করেন। তখন বর্বর হানাদাররা নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের উপর অতর্কিতে গুলি বর্ষন করছিল। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব জনগণের পূর্ণ বিশ্বাস ও সমর্থন পেয়েছিল। তাঁদের ডাকে জনগণ গোপন আশ্রয় নিয়েছিল এবং দেশকে মুক্ত করার জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
১০ এপ্রিল ১৯৭১ এক ঘোষনার মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল যা মুজিবনগর থেকে ইস্যু করা হয়েছিল। এথানে উল্লেখ্য এই ঘোষনা বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্বের ঘোষণাকে দৃঢ়ীকরণ করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রথম প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধান মন্ত্রী হয়েছিলেন জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ।
সে সময় পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী মেহেরপুরকে দখলে নিলেও পৌঁছুতে পারেনি বৈদ্যনাথতলায়। তদানীন্তন মেহেরপুর মহাকুমার বাগোয়ান ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী বৈদ্যনাথতলা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সমস্ত সময়টুকু ধরেই এ জায়গাটি ছিল নির্বিঘ্ন। বি্িরটশ শাসনামলে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার অন্তর্গত মেহেরপুর ছিল মহাকুমা শহর।
সে সুবাদে কলকাতার সাথে এই বৈদ্যনাথতলার সরাসরি সড়ক যোগাযোগের ব্যাবস্থা ছিল। (বন্ধ রাস্তাটি স্বাধীনতা সড়ক নামে পুণরায় নির্মাণ শুরু হয়েছে এবং আমাদের অংশ নির্মাণ শেষ হয়েছে।)
সরকার গঠনের পর মুজিবনগরকে অন্তর্বর্তীকালিন রাজধানী ঘোষনা করা হয়েছিল। পাশাপাশি স্বাধীনতার ফরমান জারি করে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা হয়েছিল। এই সময় ও শপথ গ্রহণের স্থানকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে বৈদ্যনাথতলা নাম পরিবর্তন করে নাম রাখা হয় ”মুজিবনগর”। তখন থেকে ১৭ এপ্রিলকে বলা হয় মুজিবনগর দিবস। এবং তখন থেকেই এই দিনটি মুজিবনগর দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।
সেদিন থেকেই এই ১৭ এপ্রিল হলো আমাদের রাজটিকা। মুজিবনগর সরকার দেশকে ৬টি জোনাল কাউন্সিলে ভাগ করেছিল যা জনগনের সমস্যার দেখভাল করত। সে সময় মুজিবনগর হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশের প্রেরণার উৎস এবং জাতির ভাবমূর্তি অক্ষ্ন্নু রাখতে যথাসম্ভব যাকিছু করার ছিল তাই করেছিল।
মুজিবনগরে বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন আমাদের মুক্তি সংগ্রামে এবং ইতিহাসে এক মাইল ফলক । যা বিশ্বকে সাহায্য করেছিল আমাদের মুক্তিয্দ্ধুকে সমর্থন করতে। পরবর্তীতে চুড়ান্ত ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছিল একটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে। মুজিবনগরে অস্থায়ীভাবে স্থাপিত হয়েছিল সচিবালয় যার ক্যাম্প অফিস স্থাপন করা হয়েছিল কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে।
প্রতি বছর এই নির্ধারিত দিনে মুজিবনগর আম বাগানে কিছু উচ্চ পদস্থ নেতা ও রাজকর্মচারীরা আসেন এবং সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার শপথ নেন। কিন্তু আমরা আজো বুঝতে পারিনা এই বিশেষ দিনটিকে কেন ”জাতীয় শপথ দিবস” হিসাবে ঘোষণা করা হয় না? বর্তমান সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অনেক কাজ করছেন। তার মধ্যে অনেক বড় দূরহ কাজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অন্যতম। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কয়েকটি রায়ও জনগণ পেয়েছে।
কিন্তুু যে দিনটি না হলে জাতির জীবনে আসতো না যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দেখার সৌভাগ্য সে দিনটি আজো পেলনা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। জনগণ বলছে প্রথম বাংলাদেশ সরকার আজ ১৭ এপ্রিল শপথ নিয়েছিল তাই এ দিনটি জাতীয় শপথ দিবস হিসাবে ঘোষণা করতে বাধা কোথায়?
পরিশেষে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে একটি গর্বিত ও সম্মানিত জাতি হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে।
কিন্তু ১৭ এপ্রিল আজো তার পূর্ণ মর্যাদার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি। দেশের সর্ব পশ্চিমের সীমান্তের একটি ছোট জেলা মেহেরপুর যা ইতিহাসের এক অবিচ্ছিদ্য অংশ এবং স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের মুজিবনগর। এ জেলার অনেক উন্নয়ন আশা করেও জনগণের সব প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। কিন্তু বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন, এখন অন্তত ১৭ এপ্রিলকে জাতীয় দিবসের মর্যাদা দিয়ে এ অঞ্চলের জনগণ তথা দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করা সম্ভব।
তাই এই সরকারের কাছে জনগণের দাবী ১৭ এপ্রিলকে রাষ্ট্রীয় ভাবে ”জাতীয় শপথ দিবস” ঘোষনা করা হউক। যেহেতু ১৭ এপিলের ইতিহাস কোন দল বা গোষ্ঠির একক ইতিহাস নয় তাই যে রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটের রায় নিয়ে নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করবে, তাঁরা ক্ষমতায় বসার পূর্বে এই মুজিবনগরে এসে শপথ নিতে হবে। আর বছরে কমপক্ষে ৩টি মন্ত্রী পরিষদের সভা মুজিবনগরে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।
তাহলে জনগণ ও আগামী প্রজন্ম বুঝবে ১৭ এপ্রিল কি আর মুজিবনগরই বা কি? আারো বুঝতে পারবে সেই মহান নেতা বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে যাঁর নেতৃত্বে এদেশ হয়েছে স্বাধীন।
তাছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ জনগণ বাংলাদেশ টেলিভিশনে জাতীয় সংবাদ প্রচারিত হওয়ার আগে জাতীয় স্মৃতি সৌধের পাশাপাশি মুজিবনগরে অবস্থিত স্মৃতি সৌধটিও দেখতে চায়। বাংলাদেশ সরকার প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা মুজিবনগর দিবসে ১৭ এপ্রিলকে জাতীয় শপথ দিবস হিসাবে ঘোষনা দেবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।