বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা বৈধ গণতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে অবৈধ ক্ষমতা দখলদার সেনা শাসকদের হাতে চলে যায়। তারা নেতৃত্বের দায়িত্ব দেয় সে সময়ের আর্মি চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের উপর। জিয়ার তখন মূল অ্যসাইন্টমেন্ট খুনিদের বাঁচানো। এর জন্যে দরকার ছিল ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা। এজন্য তিনি ক্ষমতায় থেকে দল গঠন এবং একের পর এক নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতা বৈধ করার চেষ্টা করতে থাকেন। এর যেসব রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহার করতে থাকেন তার নির্বাচন ছিল অন্যতম। চলুন পাঠন আমরা দেখে নেই কেমন ছিল সেই নির্বাচনগুলো।
হ্যাঁ / না ভোট আয়োজন, ১৯৭৭ সাল
জিয়াউর রহমান তখন একইসাথে দেশের রাষ্ট্রপতি,সেনা প্রধান এবং প্রধান সামরিক আইন শাসক। সেনাবাহিনীতে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বিরোধীরা বিচ্ছিন্ন এবং দিশেহারা। তারপরেও জিয়াউর রহমানকে প্রমাণ করতে হবে, তার জনসমর্থন আছে। শুধু বন্দুকের জোরে তিনি ক্ষমতায় বসেননি। তাই ১৯৭৭ সালের ৩০ মে তার রাষ্ট্রপতি নিয়োগের বৈধতার জন্য প্রথমেই আয়োজন করে হ্যাঁ/না ভোটের। মূলত এই হ্যাঁ/না ভোটের মাধ্যমেই বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া শুরু হয়। এতে ভোটার উপস্থিতি ২ শতাংশের নিচে হলেও দেখানো হয়েছিল ৮৮ শতাং শ। আর প্রদত্ত ভোটের ৯৮ শতাংশই দেখানো হয় জিয়ার পক্ষে।
১৯৭৮এ অনিয়মে ভরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
২১ এপ্রিল,১৯৭৮ তারিখে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলেন। নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ হয় ৩ জুন, ১৯৭৮। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিয়া ছিলেন জাতীয়তাবাদী জোটের প্রার্থী। তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন গণঐক্য জোটের প্রার্থী অবসর প্রাপ্ত জেনারেল এম এ জি ওসমানী। অথচ বাংলাদেশের আর্মি অ্যক্টের ২৯২,২৯৩ বিধিতে ছিল , সামরিক বাহিনীর কোন সদস্য তার চাকরির মেয়াদ শেষ না করে নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না । এছাড়া রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ অনুযায়ী কোন সরকারি চাকরিজীবী ও সরকারি বেতন গ্রহিতার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হবার সুযোগ ছিল না। কিন্তু জিয়া সব আইন ভঙ্গ করে ১৯৭৮ সালের ৩জুন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
সেসময়কার গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং সরকারি চাকরিজীবীদের জিয়ার পক্ষ নিতে বাধ্য করা হয়। সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে ছাপানো জিয়ার নির্বাচনী পোস্টারে পুরো দেশ ছেয়ে যায়। সরকারি গণমাধ্যমে ঢাকঢোল পিটিয়ে তার নির্বাচনী সমাবেশের খবর প্রচার করে।
অপর প্রার্থী ওসমানী অভিযোগ করেন, গণমাধ্যমে তার বক্তব্য বিকৃতভাবে হয়। তাকে নিয়ে একের পর এক ভিত্তিহীন রিপোর্ট প্রকাশ হয় সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকায়। এই নির্বাচনে গণঐক্য জোটের ৪০জন কর্মীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা তথ্য পাওয়া যায় ২০০টির বেশি কেন্দ্রে। পোলিং এজেন্ট আর নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের বের করে দেয় সংবাদ ছাপা হয় দেশি পত্র-পত্রিকায়।
নির্বাচন কাভার করতে আসা নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক উইলিয়াম বর্ডার ১৯৭৮ সালের ৪ জুন প্রকাশিত রিপোর্টে প্রচুর জাল ভোট আর প্রতিপক্ষ এজেন্টদের নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে বের করে দেবার খবর এবং ছবি ছাপে। তার পরেও শতকরা ৭৬ ভাগ ভোট দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি হন জিয়া।
প্রশ্নবিদ্ধ ১৯৭৯ সালের নির্বাচন
১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান তার একক নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল বিএনপি গঠন করেছিলেন। তার সামরিক ক্ষমতা বেসামরিক মোড়ক পরিয়ে পাকাপোক্তভাবে পরিচালনা করার জন্য ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন জিয়াউর রহমান। আবদুল মালেক উকিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে ছিল তার প্রধান প্রতিপক্ষ।
১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও দুর্নীতির অভিযোগ ওই সময়ের কোন কোন গণমাধ্যম প্রকাশ করে। অভিযোগ আসে গুণ্ডা বাহিনীর কেন্দ্র দখলের। পাশাপাশি সেনাবাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তাদের প্রমাণ পাওয়া যায়। আওয়ামী লীগ প্রার্থী এবং নেতা কর্মীদের উপর চালানো হয় অত্যাচর ।
সংবিধান লঙ্ঘন করে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পিডিবি এবং নেজামে ইসলামের যুদ্ধাপরাধীদের নতুন জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়। কারচুপির সুযোগ দিয়ে তাদেরকেও ২০টি আসনে জয়ী দেখানো হয়। জিয়ার বিএনপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ২০৭টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িক ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে কবর দেয়া হয়েছিল, জিয়া তা কবর থেকে তুলে এনে নতুন জীবন দিয়েছিলেন। বিএনপির মনোনয়নে বিপুল সংখ্যক দালাল ও স্বাধীনতা বিরোধীকে বিজয়ী করে জাতীয় সংসদে আনা হয়। রাজাকারদের পবিত্র সংসদে ঢোকার সুযোগ করে দেন জিয়া।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা এবং পাকিস্তানের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘে ছুটে যাওয়া শাহ আজিজুর রহমান এবং রাজিয়া ফয়েজের মত কুখ্যাত রাজাকারদের জিয়াউর রহমান ভোটকারচুপির মাধ্যমে জিতিয়ে এনেছিলেন সে নির্বাচনে।