প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে মানুষের জীবন। একসময় যেসব সেবা পেতে ঘরের বাইরে বের হতে হতো, এখন তা ঘরে বসেই ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইলে অ্যাপে সেই প্রয়োজন মেটাতে পারছে জনগণ। কয়েক বছর আগেও মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি যে, জীবন এত সহজ হবে।
আগে যেখানে ব্যাংকের লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষকে বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধ করতে হতো। কিংবা অর্থ লেনদেন করতে হতো। এখন মোবাইল ব্যাংকিং ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা সহজে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই করা যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংকের অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে।
নিজস্ব অ্যাপ থেকেই টাকা প্রয়োজন মতো খরচ এবং বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা করতে পারছেন গ্রাহকরা। ‘বিকাশ’ ও ‘নগদ’-এর মতো অসংখ্য অ্যাপ আছে মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করতে। দেশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় দ্রুত সময়ের মধ্যে অর্থের লেনদেন যেমন করা যাচ্ছে, ঠিক তেমনি মোবাইল ফোনে রিচার্জ, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাসের বিল দেওয়ার কাজগুলোও এই অ্যাপের মাধ্যমে করা যাচ্ছে।
আবার ঘরে বসে বাস, ট্রেন, প্লেনের টিকিট এবং শহরে যাতায়াতের জন্য উবার অ্যাপের ব্যবহার হচ্ছে। মানুষ টিকিট কাটতে পারছে ‘সহজ’ নামের একটি অ্যাপের মাধ্যমে। এয়ারলাইনস অ্যাপ, ‘রেলসেবা’র মতো অ্যাপ ব্যবহার হচ্ছে। একসময় টিকিটের জন্য রেল বা বাসস্টান্ডে রাত্রিযাপন করতেও দেখা গেছে যাত্রীদের।
সেই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে সহজ সমাধান দিয়েছে এই অ্যাপগুলো। যাত্রীরা মোবাইল অ্যাপের এক ক্লিকেই কাঙ্ক্ষিত টিকিট পেয়ে যাচ্ছেন। এর বাইরে সরকারি বিভিন্ন সেবা পেতেও মানুষজন এখন মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করছেন। করোনা টিকা নিতে ‘সুরক্ষা’ অ্যাপ ঘটিয়েছে এক বিশালযজ্ঞ। সহজে ঘরে বসে কয়েক কোটি মানুষ এর মাধ্যমে নিবন্ধন করতে পেরেছেন। এর বাইরে সরকারি সেবা গ্রহণের জন্য রয়েছে আরও বেশকিছু অ্যাপ।
একটি প্রাইভেট ব্যাংকের কর্মকর্তা মুনমুন হক বলেন, বাসা থেকে আমার অফিসের গন্তব্য অনেকটা দূরে। সকালে অফিস যাওয়ার সময় বাস বা অটোরিকশা ধরতে গেলেও আমার ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা লেগে যেত। এসব কারণেই অফিসে সময়মতো পৌঁছাতে পারতাম না।
কিন্তু ‘উবার’ অ্যাপ সেই সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়েছে। আমি প্রতিদিন সকালে উবারে কল করি, একটা টেক্সি চলে আসে পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে। আমি নির্ঝঞ্ঝাটভাবে অফিসে পৌঁছাতে পারি। এটা একটা মেয়ের জন্য অনেক বেশি স্বস্তির বলে জানান তিনি।
সিঙ্গেল মাদার রেবেকা সুলতানা বলেন, ১৩ বছরের এক সন্তানকে নিয়ে রাজধানীতে থাকতে পারছেন শুধু প্রযুক্তির সুবিধার জন্যই। তিনি বলেন, বাসাভাড়া আমার প্রবাসী বাড়িওয়ালাকে পাঠাই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। বাসার সব বিল পরিশোধ করি অ্যাপ ব্যবহার করে। চাকরির কারণে বন্ধের দিন ছাড়া বাজারে যেতে পারি না। ‘চাল ডাল ডট কম’ এর মাধ্যমে সেই বাজারসমস্যার সমাধান করতে পারি। প্রযুক্তির এসব সুবিধা না থাকলে হয়তো ছেলেকে নিয়ে গ্রামে চলে যেতে হতো। এতবড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারতাম না। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ডিজিটালাইজেশনের জন্য।
ব্যাচেলর শিহাব হোসেন বলেন, করোনাকালে আমার বাসায় রান্নার কোনো বুয়া ছিল না। আমি নিজেও তেমন কোনো রান্না পারি না। ফলে ফুড বেচা-কেনার অ্যাপগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। এসব সুবিধা না থাকলে হয়তো করোনাতে না মরলেও খাবার সংকটে মরে যেতে পারতাম। শিহাব বলেন, রাতে এক দিন হটাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ি। তখন ‘ও ভাই’ নামক অ্যাপের মাধ্যমে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ডেকে আমি হাসপাতালে যাই।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেছেন, দেশের ৭০ শতাংশ তরুণ প্রযুক্তিনির্ভর। তারাই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বে। এ লক্ষ্যে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে কার্যকর সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল বাংলাদেশের এই প্ল্যাটফর্মের চালিকা শক্তি হচ্ছে দেশের ৭০ শতাংশ তরুণ। বর্তমানে দেশের সাড়ে ৪ কোটি শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, প্রযুক্তি মানুষের জীবনে যেমন নানা ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য আনে, তেমনি জীবন ঝামেলাযুক্ত করে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সতর্ক হতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমাদের অর্থ যেন আরেক জন নিয়ে না যায় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। তিনি বলেন, আজকে বিভিন্ন ধরনের বিল থেকে শুরু করে নানান ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনও করা হচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে। সেক্ষেত্রে অ্যাপে নিজের তথ্যও শেয়ার করতে হয় বা হচ্ছে। অস্থিরচিত্তের নতুন প্রজন্ম কোথায় কী তথ্য শেয়ার করছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হবে।