বনপোড়া হরিণের কি পুব-পশ্চিম বা উত্তর-দক্ষিণ জ্ঞান থাকে! আত্মরক্ষার জন্যে সে কেবলই দৌড়োয়, ডান থেকে বামে, আবার বাম থেকে ডানে। বাঁচাটাই মুখ্য। বাঁচার জন্যেই দৌড়নো। জোড়পুকুরের গণহত্যার শিকার সেদিনের তাড়া খাওয়া অসহায় মানুষগুলো চৌদ্দপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে, বাগান-পুকুর জমিজিরেত সব কিছু পেছনে ফেলে ছুটে চলেছিল পশ্চিমে। হ্যাঁ, পশ্চিমেই প্রাণের নিরাপত্তা। হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে গত দেড় মাস ধরে কত মানুষ যে খালবিল নদীনালা তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে পশ্চিমে গেল, দূর দূরান্তের সেই সব বাস্তুচ্যুত মানুষের পরিসংখ্যান কে রাখে! তবে তাদের গন্তব্য ঠিক পশ্চিমে। কী আছে পশ্চিমে! পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বাঙালির বাস। তারাও মাকে মা বলে, বাবাকে বাবা। একই মাটি মাঠের সবুজ, বনবনানী পশুপাখি, একই রকম জীবনধারা। তবু পৃথক দুই রাষ্ট্রের বাসিন্দা দুই রকমের পরিচয়। তবু মরা নদীর ধারার মতো শুষ্কপ্রায় সম্পর্কও আছে দু’পারের মধ্যে। সবার না থাকুক, সীমান্তঘেঁষা এ অঞ্চলের সব গ্রামেরই কারো না কারো আত্মীয় স্বজনও আছে পশ্চিমবঙ্গে। যুদ্ধের উত্তাপ এবং আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে সেই তাড়া খাওয়া দুঃসময়ে আত্মীয় অনাত্মীয়ের ভেদরেখা সহজেই আড়াল হয়ে যায়। আত্মীয়ের ভরসায় নয়, স্রেফ প্রাণের তাগিদে বহু দূর দূরান্তের এই সব ভিটেমাটিহারা মানুষেরা প্রতিদিনই দুর্গম কাদাপাঁকের পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে চলেছে পশ্চিমে।
পশ্চিমে কোথায়, কোন গ্রামে? না তারও কোনো ঠিক ঠিকানা জানা নেই। সীমান্তবর্তী গাংনী থানার একেবারে পশ্চিমের যে কোনো গ্রামের মধ্য দিয়ে অনায়াসে পৌঁছুনো যায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, শুধু এইটুকু তথ্য জানে পিঁপড়ের সারির মতো চলমান দেশত্যাগী মানুষেরা। সামান্য এই জানাটুকুর উপরে ভরসা করে অজানা-অচেনা গন্তব্যে পা বাড়িয়েছে শত শত নারী পুরুষ। অক্ষম বৃদ্ধ, অসহায় শিশু, গর্ভবতী মা — কারো ক্ষমা নেই ;যতক্ষণ পারো নিরুদ্দিষ্ট এই মানবমিছিলে চলতে থাকো, পিছিয়ে পড়লেই হারিয়ে যাওয়া। পেছনে তাকাবার সময় কারো নেই।
এ এক বিচিত্র মানবপ্রবাহ। খুব যে সুসংগঠিত এবং সুসংবদ্ধ, তাও বলা যাবে না। হিন্দুপ্রধান এলাকার বিভিন্ন গ্রামের গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষ। পাকিস্তানি আর্মি এবং তাদের এ দেশীয় দোসরেরা আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে সারা গ্রামে, পলায়নপর মানুষকে সামনে পেলেই হত্যা করেছে নির্বিচারে, লুট করেছে সোনাদানা সহায় সম্পদ ; তারপরও মানুষ বাঁচতে চায়, শুধু প্রাণ নিয়ে বাঁচতে চায়। জন্মভিটে ছেড়ে মানুষ বাঁচে কী করে সে বিদ্যে কারো জানা ছিল না। সদ্যমৃত বাবার মরদেহ ফেলে রেখে, হায়েনার হাতে সম্ভ্রমহারা বোনকে ছেড়ে, সংজ্ঞাহারা বৃদ্ধা মাকে ঝুড়িতে বসিয়ে গ্রাম-গ্রামান্তরে টেনে টেনে পাড়ি দিয়ে হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে এ কোন বাঁচা, কে জানে!
মৃত্যুর চোখ রাঙানিকে পিছে ফেলে মানুষ তবু ঊর্দ্ধশ্বাসে ছুটে চলে বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে। পথে পথে কত দুর্বিপাক, কত না বিড়ম্বনা, তবু বেঁচে থাকার কী যে এক দুর্নিবার মোহ!
সারাদিন হেঁটে হেঁটে পায়ের পাতা ফুলে ঢোল, ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তিতে সারা শরীর অবসন্ন, তবু যেতে হবে পশ্চিমে । দিনের শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে অন্ধকার দৈত্য এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। তখন কী করে ঘরছাড়া মানুষের দল! পথের পাশে কোনো খড়ের চালা অথবা কারো খোলা বৈঠকখানায় রাত্রিযাপনের জন্যে মাথা গোঁজে। কেউবা আরো কয়েক পা এগিয়ে প্রাইমারি স্কুলে আশ্রয় নেয়। কোথাও দু’হাত জায়গা খালি নেই, মানুষে মানুষে ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি। আলমডাঙার গোবিন্দপুর থেকে আসা দলটি আগেভাগে
স্কুলঘরের দখল নিয়েছে। ফলে পরে আসা লোকজনের পক্ষে স্থান সংকুলান কঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু ফরিদপুরের পাংশা থেকে আসা দলের সদস্য মধ্যবয়সী এক গর্ভবতী নারী আর কিছুতেই ভার বইতে পারছে না। কখন কী ঘটে যায়, বলা মুশকিল। তার জন্যে স্কুলঘরের এক বারান্দায় কাপড় টানিয়ে তাৎক্ষণিক এক আঁতুড়ঘর তৈরি করে দেওয়া হয়। সেই ঘেরা স্থানে প্রসূতি ঢোকার পরপরই নবজাতকের ট্যাঁ ধ্বনি শোনা যায়।
বাইরে তখন বারোয়ারি খিঁচুড়ি বিতরণ শুরু হয়েছে। এ গ্রামেরই কতিপয়
স্বেচ্ছাসেবক সপ্তাহ খানেক থেকে এ উদ্যোগ নিয়েছে। তার পেছনেও বিশেষ এক কারণ আছে। দুঃসময়ে মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়ায়, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয় ; আবার এই দুঃসময়কে পুঁজি করে দুর্গত মানুষের সর্বনাশ করার মতো অমানুষেরও তো অভাব নেই। দূরাঞ্চলের অসংখ্য মানুষ প্রায় প্রতিদিনই মাথায় টিনের সুটকেস, কাপড়ের পোটলা,
শেষ সম্বল সোনাদানা হাতের মুঠোয় নিয়ে এ গ্রাম্য কাদাপাঁকের রাস্তা ধরে পশ্চিমে যাচ্ছে, পথিমধ্যে কোথাও রাত্রি যাপন করে ভোরের আলো ফোটার আগেই আবারও রওনা হচ্ছে দুরু দুরু বুকে; কোনো রকমে বর্ডার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারলেই তারা বাঁচে। কিন্তু বাঁচা ব্যাপারটা কি এতই সহজ! গ্রাম্য কিছু দুর্বৃত্ত এসে পথ আগলে দাঁড়ায়, কেড়ে নেয় দেশত্যাগী অসহায় মানুষের সর্বস্ব। আর্মি ক্যাম্পে খবর দেবে বলে তারা ভয় দেখায়। এভাবে পরপর কয়েক দফা লুটপাটের ঘটনা ঘটলে ষোলোদাগের বেশ কিছু সাহসী মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে, রাতের আশ্রিত ক্ষুধার্ত মানুষের জন্যে খিচুড়ির ব্যবস্থাও করে দেয়। এরই মধ্যে নবজাতকের আগমন নতুন মাত্রা যোগ করে। কয়েকজন আমুদে স্বেচ্ছাসেবক শামু ময়রার ঘুম ভাঙিয়ে গুড়ের তৈরি মিঠাই এনে মিষ্টিমুখেরও আয়োজন করে বসে। নবজাতকের নাম রাখা হয় জয়া। ক্ষুদ্র মানবপিন্ড জয়া সে রাতে আশ্রয়কেন্দ্রের ক্লান্ত শ্রান্ত উৎকন্ঠিত মানুষ গুলোর মধ্যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে। নানা জায়গা থেকে প্রাণভয়ে ছুটে আসা এতগুলো অচেনা মানুষ জয়াকে ঘিরেই পরস্পরের আত্মীয় হয়ে ওঠে সহসা।
সেদিন সন্ধ্যা থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি।
আকাশ নুয়ে আছে মাথার উপরে। জয়াকে নিয়ে প্রাথমিক উচ্ছ্বাস স্তিমিত হয়ে এলে স্বেচ্ছাসেবকদের অনেকে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু ততক্ষণে বৃষ্টির ধারা ঘন হয়ে এসেছে। এরই মাঝে আঁতুড়- ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে এক মহিলা ঘোষণা করে — প্রসূতির অবস্থা সুবিধার নয়, রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।
সর্বনাশ! এই বৃষ্টিভেজা রাতে কী উপায় হবে!
ডাক্তার বলতে সারা গ্রামে আছে এক হোমিওপ্যাথ সাইফুল হাজী। এত রাতে বাদলা মাথায় সেই হাজী সাহেব কি স্কুল পর্যন্ত আসবেন! রাশভারি প্রকৃতির মানুষ, তাকে ডাকতেই বা কে যাবে! কেউ কেউ মন্তব্য করে — হোমিও ডাক্তার দিয়ে কী কাজ হবে! এ সব ক্ষেত্রে আম্বিয়ার মায়ের হাতযশ অনেক। তাকে দেখাতে পারলে ভালো হয়। তা বটে। পুরানো দাই হিসেবে এ তল্লাটে ঢের ডাক-নাম আছে তার। অন্তত শতাধিক বাচ্চা জন্ম নিয়েছে তার হাতে। তার অভিজ্ঞতার বিষয়ে কারো কোনো সংশয় নেই। তবু প্রশ্ন ওঠে, এই বেসামাল রক্তপাত কি সে রুখতে পারবে?
শেষ পর্যন্ত স্কুলপাড়ার রুস্তম শেখের গরুগাড়িতে ছই লাগিয়ে নবজাতক এবং প্রসূতিকে পাঠানো হয় আম্বিয়ার মায়ের কাছে। সঙ্গে যাবে কে? জয়ার বাপ আরো মাসখানেক আগেই ভারতে গেছে মুক্তিযোদ্ধা হবার জন্যে। দুই পুত্রসহ গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে গেছে বৃদ্ধ শ্বশুর শাশুড়ির কাছে। এখন শেকড়বাকড় সব
উপড়ে সবাই চলেছে নিরুদ্দেশের পথে। মেয়ের ঘরের নাতিনাতনি শুধু নয়, সঙ্গে আছে দুই ছেলে, দুই বৌমা এবং তাদের গন্ডাখানেক বাচ্চাকাচ্চা।এ সব ফেলে কে যাবে জয়ার মায়ের সঙ্গে!
দুই.
কুষ্টিয়া-মেহেরপুর প্রধান সড়কে পাকিস্তানি আর্মির চলাচল বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে মাত্র তিনদিন আগে মুক্তিবাহিনীর একটা গ্রুপ এসে জোড়পুকুরের পাশের গ্রাম তেরাইলের কাঠের পুল উড়িয়ে দিয়ে যায়। তার জন্যে খেসারত দিতে হয় তেরাইলের সাধারণ মানুষকে। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেবার সন্দেহে বামুন্দি ক্যাম্পের আর্মি এসে সারা গ্রামে তান্ডব চালায়, রাস্তার দু’পাশের বাড়িঘরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে নিরীহ মানুষ হত্যা করে, বেশ কজন গৃহবধূকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে ; তারপর বিপর্যস্ত কাঠের পুল মেরামতে হাত দেয়।
এ ঘটনার পর তেরাইল এবং জোড়পুকুরের অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে পাড়ি দিতে শুরু করে। দূর-দূরান্তের দেশত্যাগী মানুষের মিছিলে স্থানীয় মানুষজনও যুক্ত হয়। তারা একেবারে রাতের শেষ প্রহরে, ভোরের আজানের পরপরই জোড়পুকুরে প্রধান সড়কের পাশে খাদের মধ্যে জড়ো হয়, পাকারাস্তা ফাঁকা পেলেই দলে দলে রাস্তা পেরিয়ে চলে যায় গ্রম্যপথ ধরে ভোমরদহ- ভরাট- দুর্লভপুর, মাত্র মাইল চার-পাঁচেক পেরোলেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। মানুষ তাই ছুটে চলে পশ্চিমে। পশ্চিমেই খুঁজে ফেরে বাঁচার ঠিকানা।
সেদিন সারারাত টিপটিপ বৃষ্টি ঝরিয়ে ভোরের আকাশ আঁচল গুটিয়ে নিলে দিগন্তে উঁকি দেয় বেশ কিছু রাতজাগা তারা। ভোরের আলো ফোটার আগেই ষোলোদাগ প্রাইমারি স্কুলে গাদাগাদি করে থাকা আশ্রিতজনেরা পোটলাপুটলি গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে ত্রস্তপায়ে। যাবে তারা পশ্চিমে। হাতে সময় নেই। আরো মাইলখানেক হেঁটে জোড়পুকুরে গিয়ে পাকারাস্তা পেরোলে তবেই স্বস্তি। সারা গ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ির বৈঠকে দহলিজে রাত কাটানো লোকজনেরাও পথে এসে যুক্ত হয় মানবপ্রবাহে। তাদের মধ্যেই কে একজন ঘোষণা করে — জয়ার মা যাবে না এই দলে। অপ্রতিরোধ্য রক্ত ক্ষরণে সে মারা গেছে ভোরের পোয়াতি তারা ফোটার আগেই। আম্বিয়ার মা চেষ্টা কম কিছু করেনি। তার জ্ঞান-বুদ্ধি- অভিজ্ঞতা সব ব্যর্থ করে দিয়ে যে যাবার সে চলে গেছে। আর সদ্যোজাত জয়া? তার কী হলো?
না, সেই হুলুস্থুল দুঃসময়ে জয়ার সঠিক সংবাদ কেউ জানাতে পারে না। কেউ বলে বেঁচে আছে, কেউ বলে মায়ের রক্তস্রোতে সেই অবাগীও ভেসে গেছে। তখন সবাই সামনে যেতে চায়। এক পাড়া পিছিয়ে এসে আম্বিয়ার মায়ের কাছে খোঁজ নেবার অবকাশ কারো নেই। ভোরের আলো ফুটে যাবে, চলো, পা মেলাও, সামনে বাড়ো। হঠাৎ জয়ার নানি বুক চাপড়ে কেঁদে ওঠে, তারপরই কাফেলার ছন্দপতন ঘটে, মুখে দাঁতি লেগে বেহুঁশ হয়ে যায় বৃদ্ধা। প্রভাতবেলায় এ কোন গেরো! তার পেটের ছেলেরাও মহাবিরক্ত — এটা কি জ্ঞান হারাবার সময় হলো! শেষে কি মাকেও ফেলে যেতে হবে স্কুলমাঠের এই বিরান প্রান্তরে! ছোটছেলে রতন আঁজলা ভরে পানি এনে চোখে মুখে ঝাপটা দিতেই জ্ঞান ফিরে আসে বৃদ্ধার। তখন তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে পা বাড়ায় জোড়পুকুরের পথে।
তেরাইলের কাঠের পুল পুননির্মাণের পর মেহেরপুর থেকে বামুন্দি হয়ে কুষ্টিয়া- যশোর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সড়ক যোগাযোগ নির্বিঘ্ন হয়ে যায়। ফলে খাদ্য রসদ অস্ত্র গোলাবারুদ সরবরাহ নিশ্চিত এবং নিরাপদ হয়। কিন্তু একেবারে নিশ্চিত হতে পারে না— বাঙালি বিচ্ছু বলে কথা! তেরাইল ব্রিজের দু’পারে তাৎক্ষণিক ভাবে পাহারা-চৌকি বসানো হয়েছে রাজাকার এবং মিলিশিয়া দিয়ে। তারা ব্রিজের এপারে ওপারে পালা করে টহল দেয়। কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে বেশ লেফট রাইট করে, মুসলিমলীগ নেতা গনি বিশ্বাস বুকে থাবা দিয়ে সাহস যোগায়, তবু তারা রাত গভীর হলে ওই কাঠের ব্রিজে উঠতে চায় না, পা কাঁপে। মধ্যরাতে গেরিলা যোদ্ধারা যদি আবার ব্রিজ উড়িয়ে দিতে আসে! বলা তো যায় না! নিজেদের ভয় ঢাকতে তারা বামুন্দি ক্যাম্পের পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনকে দুদিন পরেই খবর দেয় — ভোররাতের দিকে দুষ্কৃতিকারীদের আনাগোনা টের পেয়েছে। ইন্ডিয়া থেকে সশস্ত্র অবস্থায় এসে জোড়পুকুরে পাকা রাস্তা পার হয়ে মেঠোপথ ধরে ছড়িয়ে পড়ে আলমডাঙা, হালসা, পোড়াদহ এবং সারা দেশে। ব্যাস, জায়গামতো একটুখানি টোকা দিতেই আঁচলাগা এঁড়ে গরুর মতো লাফিয়ে ওঠে পাকিস্তানি সৈন্যরা। গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে মুক্তিফৌজ ধরার চেয়ে জোড়পুকুরে একত্রে ওদের গুছিয়ে পাওয়া যাবে, এ তো বড়ই ভালো খবর। রাজাকাররা অতি উৎসাহে আরেক কাঠি এগিয়ে যায়, জোড়পুকুরের ওই পথ ধরে বিভিন্ন জায়গার শরণার্থীরাও ভারতে পাড়ি দেয় — সে কথাও সগৌরবে জানিয়ে আসে।
সেদিন প্রভাতবেলা নতুন দিনের সূর্য এসে বৃষ্টিধোয়া আকাশের গায়ে রক্তিম আবীর মাখিয়ে দেবার আগেই রক্তের হোলিখেলা শুরু হয়ে যায় জোড়পুকুরে। প্রধান সড়কের দু’পাশের গর্তে খানাখন্দে দেশত্যাগে উদ্যত নরনারীর রক্ত জমে ওঠে। আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জন ছাপিয়ে মুমূর্ষু মানুষের আহাজারি আর শেষ আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। ব্যাকুল শিকার যখন হাতের কাছে প্রস্তুত, শিকারী বিলম্ব করবে কেন? বামন্দি ক্যাম্প থেকে গাড়ি ভর্তি হয়ে যমদূতেরা জোড়পুকুরের নির্দিষ্ট অবস্থানের দিকে বেপরোয়া গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে, তারপর ব্রাশফায়ার। প্রথম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় গ্রুপের জনা তিরিশেক মানুষ প্রধান সড়ক পেরিয়ে ঢালুতে নামতে না নামতেই শুরু হয় বিরামহীন গুলি বর্ষণ। জল্লাদেরা কোথাও প্রাণের স্পন্দন অবশিষ্ট রাখতে চায়নি। সত্যিকারের কথায় সেদিনের এ গণহত্যায় ঠিক কতজন শহিদ হয়, সে হিসেব আদৌ কোনোদিন করা হয়ে ওঠেনি, হয়তো আর হবেও না কখনো। তবে এই বাংলার মাঠঘাট সবুজ প্রান্তর খুব জানে, ভালোই জানে– তারা সবাই বাঁচতে চেয়েছিল।
পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের পরের আশ্চর্যটি হচ্ছে এই যে এমন ভয়াবহ মৃত্যু প্রবাহ কিন্তু সে রাতে ভূমিষ্ঠ জয়াকে গ্রাস করতে পারেনি। অভিজ্ঞ ধাত্রী আম্বিয়ার মা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দিয়েও যখন রক্তক্ষরণের রুগি বাঁচাতে পারেনি, তখন সদ্যোজাত শিশুটির কচি কোমল কণ্ঠের চিৎকারধ্বনি তাকে আকুল করে তোলে। জয়ার মায়ের সিঁদুর রাঙা মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে রেখে তখন সে জয়াকেই পরম মমতায় কোলে তুলে নেয়। ওইটুকু শিশু কী ভেবে কান্না থামিয়ে তার রক্তাভ চোখের পাতা পিটপিট করে ওঠে। বৃষ্টি ধোয়া আকাশের এক কোনে তখন দ্বিতীয়া কিংবা তৃতীয়ার স্বল্পায়ু চাঁদ ম্লান ঠোঁটে দিব্যি হেসে ওঠে অম্লান।