বর্তমান সরকারকে বলা হয় কৃষি বান্ধব সরকার। এই সরকার ক্ষমতায় আসার পরেই খাদ্যে সয়ংসম্পুর্ণতা অর্জণের লক্ষ্যে কৃষিতে বেশি বরাদ্দ দিয়ে আসছে। নতুন নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে উৎপাদন বৃদ্ধি ও অনাবাদি জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। সরকার ৩ হাজার ২০ কোটি টাকার প্রাক্কলিত বরাদ্দে ২০২১ সালের জুন থেকে শুরু করেছে সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্প। সরকার স্বচ্ছভাবে এই প্রকল্প পরিচালনার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঝিনাইদহের চিত্র ভিন্ন। সমন্বিত ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পে ঝিনাইদহে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়া গেছে।
ভর্তুকীর মাধম্যে কৃষকদের মধ্যে বিতরণকৃত পাওয়ার টিলার, সিডার, কম্বাইন্ড হারভেষ্টার, রাইস প্লান্টার বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম ধরা পড়েছে, উঠে এসেছে সিন্ডিকেটের অর্থ বাণিজ্যের তথ্য। শোরুম মালিক, কৃষি কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এ সিন্ডকেট। কাজেই এই প্রকল্পের সুফল কৃষক পাচ্ছে না, নয়-ছয় করে পকেট ভরছে সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ২০২১ সালের জুন থেকে শুরু হওয়া ৫ বছর মেয়াদি প্রকল্পে এপর্যন্ত ঝিনাইদহে ১০ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রণোদনা কি কৃষক পেয়েছে? প্রকল্প শুরু হওয়ার পর থেকেই কৃষকদের আবেদনের মাধ্যমে প্রণোদনার তালিকা প্রস্তুত করার নিয়ম থাকলেও স্বজন প্রীতি ও ব্যক্তিগত লোক দিয়ে ভর্তুকীর কৃষি যন্ত্রপাতি উত্তোলন করে সেই গুলো বিক্রি করে টাকা আত্মসাৎ করছে সিন্ডিকেট। একটি পাওয়ার টিলার বাজারে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একটি সিডার ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ প্রণোদনায় কৃষি সম্পসারণ অধিদপ্তরের অনুমোদিত কোম্পনির ডিলারদের কাছে পাওয়ার টিলার ও সিডারের প্যাকেজ আড়াই লাখের উপরে।
প্রণোদনায় প্রাপ্ত যন্ত্রপাতি ৩ বছরের মধ্যে হস্তান্তর করা যাবে না এবং কৃষি বিভাগের তদারকিতে থাকবে এমন নিয়ম থাকলেও উপজেলা কৃষি অফিসে বিতরণের ফটোশুট করেই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে এমন তথ্য মিলছে। কেউ বা বাড়িতে নিয়ে যেয়েও বিক্রি করেছে। জেলার সকল উপজেলাতেই এমন অনিয়ম ধরা পড়লেও সবচেয়ে বেশি হয়েছে ঝিনাইদহ সদরে। সদরের বিতরণকৃত তালিকা সরজমিনে অনুসন্ধান করতে যেয়ে দেখা গেছে সদর উপজেলার ফুরসুন্ধি ইউনিয়নের ভবানীপুর গ্রামের মৃত খোদাবক্সের ছেলে হায়দার আলী, সুশিল বিশ্বাসের ছেলে শৈলেন বিশ্বাস (ডাক্তার), মৃত আজিম মন্ডলের ছেলে সাহাবুদ্দিন প্রণোদনার সিডার পাওয়ার টিলার পেয়েছেন। কিন্তু তাদের বাড়িতে যেয়ে পাওয়া যায়নি সেই সিডার ও পাওয়ার টিলার।
হায়দারের স্ত্রী শিউলি বেগম জানান, তাদের পাওয়ার টিলার সদর উপজেলার মধুহাটি গ্রামে তার দেবরের বাড়িতে রয়েছে। সাহাবুদ্দিনের স্ত্রী লিপি খাতুন জানান, তার স্বামী সাহাবুদ্দিন ঝিনাইদহের সেচ বিতানে কাজ করে। তারা এই পাওয়ার টিলার পেলেও শোরুম থেকে নিয়ে আসা হয়নি। শৈলেন ডাক্তার জানান, তার আগে থেকেই একটি পাওয়ার টিলার ছিলো। তাই নতুন টা তিনি বিক্রি করে দিয়েছেন। একসাথে দুইটা রেখে লাভ নেই বলেও তিনি জানান।
পার্শ্ববর্তী জিথড় গ্রামের মৃত বাবর আলী বিশ্বাসের ছেলে সাবেক মেম্বার মোস্তফার বাড়িতে পাওয়ার টিলারের খোঁজে গেলে জানা যায় একই ইউনিয়নের মাড়ুন্দি গ্রামের তুকামের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। এই গ্রামের বর্তমান ইউপি সদস্য আসাদুজ্জামান টিপু। তার প্রায় ১০ বছর আগে থেকেই একটি পাওয়ার টিলার রয়েছে।
২০২১-২২ অর্থ বছরে তিনি নতুন আরেকটি পেয়েছেন। তবে তার নিজের যেই টাকা দেওয়ার কথা ছিল তার একটি টাকাও তিনি দেননি। শোরুমের মালিক তার টাকা দিয়ে তার পাওয়ার টিলার তুলে তিনি নিজ দায়িত্বে বিক্রি করে দিয়ে কিছু নগদ টাকা তাকে দিয়ে দিয়েছেন।
আসাদুজ্জামান টিপু মেম্বার জানান, তিনি যদি জানতেন এই পাওয়ার টিলার নিয়ে এমন হবে তাহলে তিনি নিতেন না। সামান্য কিছু টাকার জন্যে তিনি দুর্নামের ভাগিদার হতে রাজি নন। একই গ্রামের মৃত শংকরের ছেলে সঞ্জিত ও মৃত নিরঞ্জনের ছেলে সুরঞ্জনও এই কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনার পাওয়ার টিলার পেয়েছেন। সঞ্জিতের পাওয়ার টিলার বিক্রি করে দিয়েছেন।
সঞ্জিতের ছেলে জানান, তার ভাই বিদেশ যাওয়ার জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল তাই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
সুরঞ্জন জানান, তার আগে থেকেই একটি পাওয়ার টিলার রয়েছে। তাই তিনি নতুনটা কিছু দিন আগে বিক্রি করে দিয়েছেন। তার ভাগ্নে কৃষি অফিসে চাকরি করে বলেও তিনি জানান। এর আগের অর্থ বছরে এই গ্রামের কংশো মন্ডলের ছেলে বিদ্যুৎ একটি পাওয়ার টিলার নেন প্রণোদনায়। তার পাওয়ার টিলারটি রয়েছে। তিনি জানান, নতুন করে যাদেরকে দেওয়া হয়েছে। তার একটিও কেও বাড়িতে আনেননি। সবাই ফটোশুট করেই বিক্রি করে দিয়েছেন। সরকারের সাথে টাকার যে অংশ তাদের দেওয়ার কথা, তা কেওই দেননি। সব কিছু শোরুম মালিক দিয়ে তুলে নিয়েছেন। এর বিনিময়ে ৪ থেকে ৬ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে যাদের নামে পাওয়ার টিলার বরাদ্দ এসেছে। এরকম অসংখ্য তথ্য মিলেছে সদর উপজেলার হরিশংকরপুর, ঘোড়শাল, সুরাট, পাগলাকানাই, সাগান্না, পোড়াহাটি, হলিধানী ও পৌর এলাকায়।কেউ হারভেস্টার নিয়েছেন, কেউ পাওয়ার টিলার বা রাইস প্লান্টার।
হরিণাকুণ্ডু ও শৈলকুপা উপজেলাতেও এমন অনিয়মের অসংখ্য তথ্য পাওয়া গেছে। কালীগঞ্জ ও মহেশপুরেও হয়েছে দুর্নীতি ও স্বজন প্রীতি। যাদের আগে থেকেই এই সমস্ত কৃষি যন্ত্রপাতি ছিল তাদেরকেই প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা নতুন একটি পেয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন। সম্প্রতি ঝিনাইদহ জেলা শহরের কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার সংলগ্ন জিন্নাহ মার্কেটের কামালের মেশিনারিজ দোকানে আনপ্যাক্টড পাওয়ার টিলার বিক্রি করতে দেখা যায়। তারা খরিদ্দার অনুসন্ধান করছিল। ক্ষমতাসীন দলের লোক ক্রেতা হলে বিক্রির পরে ঝামেলা পোহাতে হবেনা তাই এমন খরিদ্দার খুজছিলেন তারা। তাদের দোকানে খোঁজ নিয়ে জানাযায় এগুলো সব প্রণোদনার পাওয়ার টিলার।
এদের মাধ্যমে জানাগেছে, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানরা ইচ্ছামত নাম দিয়ে প্রণোদনার এই যন্ত্রপাতিগুলোর তালিকা পাশ করিয়ে এনে এভাবে বিক্রি করে দেন। এতে করে শোরুম মালিক, কৃষি কর্মকর্তা ও উপজেলা চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান সবার লাভ থাকে। কিন্তু এতে করে সরকারের এই ভর্তুকীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ হচ্ছে?
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জাহিদুল করিম জানান, প্রণোদনায় প্রাপ্ত কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো ৩ বছরের আগে বিক্রি বা হস্তান্তর করতে পারবেন না। ঝিনাইদহে যন্ত্রের প্রকার ভেদে সরকার একেক রকমের প্রণোদনা দিচ্ছেন। একটি হারভেস্টারের সরকার বর্তমানে ১৪ থেকে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ভুর্তকী দিচ্ছেন। সিডারে বর্তমানে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ভর্তুকী দিচ্ছেন। শুধু পাওয়ার টিলারে ৫০ হাজার টাকা, পাওয়ার থ্রেসারে ৪৮ হাজার, রিপারে ৯০ হাজার বেড প্লান্টারে ৯০ হাজার ভর্তুকী দিচ্ছেন সরকার। প্রতিবছর উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে কৃষি অফিসে আবেদন করতে বলা হয়। আবেদনের ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে কমিটির মাধ্যমে ঢাকায় পাঠানো হয়। পাশ হয়ে আসলে বিতরণ করা হয়। মেশিনের দাম সব প্রকল্প অফিস থেকে পাশ হয়ে আসে।
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ পরিচালক আজগার আলী জানান, কৃষক যদি পাওয়ার পরে বিক্রি করে ফেলেন তাহলে আমরা কি করবো। আমরা তো কৃষকের ভালোর জন্যই দিচ্ছি। এই বিষয়ে তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউএনওদের সাথে কথা বলতে বলেন।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিয়া জেরিন জানান, তিনি গত ডিসেম্বরে ঝিনাইদহে যোগদান করেছেন। তার যোগদানের পরে প্রণোদনার কোন যন্ত্রপাতি বিতরণ করা হয়নি। তবে যেহেতু প্রশ্ন উঠেছে এই বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান। ঝিনাইদহের অগ্নিবীণা সড়কের সেচ বিতান ও বিসমিল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং মিশনারিজ থেকেই এই কৃষি যন্ত্রপাতিগুলো সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এর মধ্য সেচ বিতান থেকেই বেশিরভাগ বিতরণ করা হয়েছে। সেচ বিতানের কর্মচারী সাহাবুদ্দিন নিজে কৃষি কাজ না করলেও তিনি পেয়েছেন প্রণোদনার পাওয়ার টিলার। অন্যান্য সকল ইউনিয়ন বা এলাকা থেকে ফুরসুন্ধি ইউনিয়নের মানুষের নাম বেশি রয়েছে তালিকায়।
জানাগেছে, সেচ বিতানের মালিক রিপনের বাড়ি ফুরসুন্ধি ইউনিয়নে। তার চেষ্টাতেই এই ইউনিয়নের লোকজনের নাম বেশি এসেছে। চলতি অর্থবছরে একটি সিডার ও পাওয়ার টিলার দিয়ে প্রকল্পে মূল্য ধরা হয়েছে দুই লাখ পঞ্চান্ন হাজার। কিন্তু খোলা বাজারে একই ব্রান্ডের একটি পাওয়ার টিলার ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার মধ্যে ও একটি সিডার ৩০ হাজার টাকার মধ্য অর্থাৎ দুই লাখ টাকার মধ্যে পাওয়া গেলেও শোরুম গুলো প্যাকেজের মূল্য নিচ্ছেন দুই লাখ ৫৫ হাজার। যেখানে প্রচলিত মূল্যের থেকে ৫৫ হাজার টাকায় বেশি নেওয়া হচ্ছে।
সেচ বিতানের মালিক রিপন অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তিনি নিজের টাকা দিয়ে কারো নামে প্রণোদনার যন্ত্রপাতি উত্তোলন করেননি। যার তা সে নিজেই করেছে। সরকারের নির্ধারিত দামেই আমরা যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছি।
জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক আলমগীর হোসেন জানান, ঝিনাইদহের বাজারে যেই পাওয়ার টিলারগুলো পাওয়া যাচ্ছে সেই গুলো মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গার। ওগুলো ঝিনাইদহের নয়। জেলায় সব থেকে বেশি সাপ্লাই দেয় সেচ বিতান, তিনি নিজের টাকা দিয়ে কোন গ্রাহকের নামে যন্ত্রপাতি উত্তোলনের সাথে জড়িত নন বলে জানান।
ঝিনাইদহ জেলা কৃষকলীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল আলম জানান, আমরা প্রণোদনার পাওয়ার টিলারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি বাজারে বিক্রি হচ্ছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে জেলার বিভিন্ন জায়গায় তদন্ত করেছি। অনেকগুলো জায়গায় এর সত্যতা পেয়েছি। আমরা আরও তদন্ত করবো। এই বিষয়ে আমরা মাননীয় কৃষিমন্ত্রীর কাছে জানাবো।
সমন্বিত ব্যবস্থার কৃষি যান্ত্রিকীকরণ প্রকল্পের পরিচালক তারিক মাহমুদুল ইসলাম জানান, সারাদেশে খুব সচ্ছভাবে এই প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে। ঝিনাইদহে কিছু অনিয়মের তথ্য আমি শুনেছি। আমরা তদন্ত করবো। সত্যতা পেলে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
উল্লেখ্যঃ প্রকল্পটি গত ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে শুরু হয়েছে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত চলবে। এই প্রকল্পের প্রাক্কলিত বরাদ্দ ৩ হাজার ২০ কোটি টাকা। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ বছরে ১৫০০০টি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। হাওর ও উপকূলীয় এলাকা দুর্যোগ প্রবণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এবং ৭০% ভর্তুকি থাকায় যন্ত্র ক্রয়ে আগ্রহ অনেক বেশি। সমতল এলাকায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিগণ পরিবারের সকলের সহযোগিতায় নিজেই চাষাবাদ করেন। প্রকল্পের মাধ্যমে ৬০০০টি রিপার বিতরণ করা যাবে। জেলার সচেতন মানুষ দাবি তুলেছেন সরকারি অর্থ সঠিক ভাবে প্রকৃত কৃষকদের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। ঝিনাইদহে সরকারি প্রণোদনার কৃষি যন্ত্রপাতি বরাদ্দ ও বিক্রির এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা।