ঢাকা মুখ্য মহানগর আদালত ভবনে সাধারণ নিবন্ধন শাখা (জিআর)। হেঁটেই এক আদালত থেকে আরেক আদালতে যাওয়া যায়। কিন্তু তিন বছরে একবারও সেখানে সাক্ষ্য দিতে যাওয়ার সময় হয়নি জিআর শাখায় কর্মরত এক কর্মকর্তার। তিনি আগে যাত্রাবাড়ী থানায় কর্মরত ছিলেন। এ থানারই একটি মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সাক্ষী তিনি। এ ছাড়া ২৬ বছর ধরে আরেকটি মামলায় হাজির হচ্ছেন না তদন্ত কর্মকর্তা ও জব্দ তালিকার সাক্ষীরা। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ না হওয়ায় ১৭ বছর ধরে বিচারকাজ চলছে দেশের প্রথম ইয়াবা মামলার। শুধু পাঁচ বছর ধরে বিচারের অপেক্ষায় ঝুলে আছে ২৬ হাজারের বেশি মাদক মামলা।
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মাদক মামলার বেশির ভাগ সাক্ষী পুলিশ। সাক্ষীকে আদালতে হাজির করানোর দায়িত্ব যেখানে পুলিশের, সেখানে পুলিশ সদস্য হয়েও তারাই সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন না। এতে থেমে থাকছে মাদক মামলার বিচার। পুলিশ বাদী এসব মামলা পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন পাবলিক প্রসিকিউটররা (পিপি)। অথচ তারাও মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে কোনো খোঁজ রাখেন না। ঢাকা মহানগর আদালতগুলোয় বিচারাধীন ও বিচার সম্পন্ন হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি পিপি কার্যালয়ে।
অবশ্য মাদক মামলার সাক্ষী পুলিশ সদস্যদের কারও কারও দাবি, কর্মস্থল পরিবর্তন হওয়ায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরনো ঠিকানায় সমন যাচ্ছে। এ কারণে তারা সাক্ষ্য দিতে যেতে পারছেন না। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপ-কমিশনার (ডিসি-প্রসিকিউশন) জাফর হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাক্ষী না পাওয়ায় হয়তো মামলাগুলো থেমে থাকে। এ ছাড়া যে পরিমাণ মামলা সে অনুসারে আদালতের সংখ্যা বাড়েনি। এক আদালতে দেখা গেছে অনেক মামলা। তবে আমরা সমন পেলে সাক্ষী হাজির করানোর চেষ্টা করি। অনেক সময় দেখা গেছে সমনের আদেশ হয়েছে, কিন্তু ইস্যু হয়নি।’ ডিবি ও থানা পুলিশের অন্তত ১০ জন মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানান, মাদক ছাড়াও বিভিন্ন মামলার তদন্তের দায়িত্ব তাদের ওপর ন্যস্ত থাকে। এর পরও আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। দেখা গেছে এক মামলার সাক্ষ্য দিতে গিয়ে সারা দিন চলে গেছে। এমন নানা কারণে তারা সাক্ষ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
একদিকে যেমন মাদক মামলার বিচার থেমে থাকছে অন্যদিকে প্রতিদিনই থানায় মাদকের মামলা বাড়ছে। সদ্যপ্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের নিম্ন আদালতে ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮৯টি মাদক মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে ২৬ হাজার ১২৪টি পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। এ ছাড়া উচ্চ আদালতের নির্দেশে স্থগিত মামলা ৩০টি। গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে মাদক মামলার সংখ্যা বেড়ে এখন ২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৯ সালে ঢাকা মহানগরীর (ডিএমপি) থানাগুলোয় মাদকের মোট মামলা হয়েছে ১৬ হাজার ৮৮০টি। গ্রেফতার করা হয় ২৫ হাজার ৮৩৫ জনকে।
আর গত বছরে মাদক মামলা হয়েছে ১২ হাজার ৬১৯টি এবং গ্রেফতার করা হয় ১৮ হাজার ৫৫৫ জনকে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের হিসাবে ২০০৯ সাল থেকে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত বিভিন্ন মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছে ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৭৬৫টি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮-তে বলা হয়েছে, বিচারের জন্য অভিযোগ আমলে নেওয়ার তারিখ থেকে ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে। তা না হলে আরও ৩০ কার্যদিবস বাড়ানো যাবে। এর মধ্যে না হলে আরও ১৫ কার্যদিবস বাড়ানো যাবে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মোতাহার হোসেন সাজু বলেন, ‘মাদক মামলার সাক্ষী হাজিরের ক্ষেত্রে সরকারপক্ষের প্রসিকিউটরের অনীহা দেখা যায়। আর পুলিশ যেখানে সাক্ষী সেখানে সাক্ষী হাজির করানো হয় মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের মাধ্যমে। যখন সাক্ষী হাজির হয় না তখন সে বিষয়টি মনিটরিং করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই।’
২৬ বছরের পুরনো মামলা : সাক্ষী হাজির করতে না পারায় ২৬ বছর ধরে ঝুলে আছে রাজধানীর কোতোয়ালি থানার একটি মামলা। ১৯৯৪ সালের ১৯ এপ্রিল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে অভিযান চালায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অভিযানে মেহেদী হাসান ও ইউসুফের কাছ থেকে ৫০০ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। পরে সিআইডির পরিদর্শক শেখ আলী হায়দার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। যার নম্বর ৩০(০৪)৯৪। আট বছর পর ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট দুই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন হয়। এরপর ১৮ বছর চলে গেছে। কিন্তু সাক্ষী হাজির হয়নি।
সূত্র জানান, ১১ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র তিনজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। অন্যদের মধ্যে আছেন তৎকালীন সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক পরিতোষ বণিক, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার তুলা পুষ্করিণী গ্রামের শাহজাহান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার শ্যামবাড়ী গ্রামের ইউনুস চৌধুরী। বাকি সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা স্পষ্ট নয়। ২০১৮ সালের ২০ মার্চ এ মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে। সম্প্রতি ওই আদালতে মামলাটির সর্বশেষ অবস্থা জানতে গেলে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলাটির অন্যতম সাক্ষী সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক পরিতোষ বণিক ২০০২ সালে ঢাকা জেলা পুলিশ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পুটিজানা ইউনিয়নের দেবগ্রামের পন্ডিতবাড়ি খোঁজ করে জানা যায় তিনি বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। পুটিজানা ইউপি চেয়ারম্যান ময়েজ উদ্দিন তরফদার জানান, পরিতোষ তার সব জমিজমা বিক্রি করে প্রায় ২০ বছর আগে ভারতে চলে গেছেন।
সাক্ষী হাজির না হওয়ায় দেশের প্রথম ইয়াবা মামলাটি ঝুলে আছে ১৭ বছর ধরে : ২০০২ সালের ডিসেম্বরে গুলশান নিকেতনে অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ শফিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েল নামে একজনকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। তার দেওয়া তথ্যে বনশ্রী থেকে শামসুল ইসলাম ও রফিকুল ইসলাম নামে আরও দুজন গ্রেফতার হন। এরা তিনজনই এখন জামিনে আছেন বলে জানা গেছে। সংস্থার পরিদর্শক এনামুল হক ওই বছরের ১৯ ডিসেম্বর গুলশান থানায় একটি মামলা করেন।
তদন্ত শেষে পরের বছরের ১৪ জানুয়ারি আদালতে চার্জশিট জমা দেয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। অভিযুক্ত আরও দুজন সোমনাথ সাহা ও এমরান হক এখনো পলাতক।
সর্বশেষ ১১ জানুয়ারি পরিবেশ আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। এ মামলারও ১৫ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র দুজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। সাক্ষ্য না দেওয়া ১৩ জনের মধ্যে রয়েছেন মাদকদ্রব্যের পরিদর্শক এনামুল হক, উপপরিচালক ড. আমিনুল ইসলাম ও হাফিজুর রহমান, সহকারী পরিচালক আমজাদ হোসাইন, হাফিজুর রহমান ও জাহিদ হোসাইন মোল্লাহ, চিফ ফরেনসিক অফিসার দুলাল কৃষ্ণ সাহা, এসআই আবহসান হাবিব ও এসআই সানোয়ার হোসাইন। বাকি চারজন সাধারণ মানুষ। তারা হলেন আবু কাজী, নুরুজ্জামান, ফাহিম হাসান ও হেমায়েত।