দামুড়হুদায় অতীতে হালচাষের গরু ও মহিষ দেখা যেত গাঁয়ের মেটোপথে-প্রান্তরে। বর্তমান যুগে পশু দিয়ে হালচাষের পরিবর্তে এসেছে মেশিন-ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার ইত্যাদি। এজন্য নতুন প্রজন্মের অনেকেই জমিতে গরু দিয়ে লাঙল কিংবা মই টানা দৃশ্যের সঙ্গে অপরিচিত। প্রযুক্তির যুগে বিলুপ্তির পথে চিরচেনা এই পদ্ধতি। সে সময় গরু-মহিষসহ বিভিন্ন গবাদি পশু দিয়ে লাঙল ও মই টানার মাধ্যমে হাল চাষের বিকল্প ছিল। কৃষকরা ভোরবেলা মাঠে গিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত এভাবে হাল চাষ করতেন।
কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। জমিতে চাষাবাদ পুরোপুরিভাবে আধুনিক হয়ে যাওয়ায় কম সময়ে লাভ বেশি হলেও মাঠ থেকে যেন হারিয়ে গেল চিরচেনা এক রূপ, কৃষকদের ঐতিহ্য।
দামুড়হুদা উপজেলার জয়রামপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষক বলেন, আগে দিনভর গরু দিয়ে হাল চাষ করতাম। কিন্তু প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে এখন অল্প সময়ে চাষবাদ শেষ করার জন্য আর আগের সেই পদ্ধতিটি ব্যবহার হয় না। এতে ফলনও বেড়েছে। তবে মাঝেমধ্যেই সেই সুন্দর দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়।
এদিকে, গরু দিয়ে হালচাষের মাধ্যমে সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন কয়েকজন চাষি। এদের মধ্যে একজন হাউলী ইউনিয়নের তারিনীপুর গ্রামের সুন্নত মিয়া। তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন বয়স্ক কৃষক এখনও গরু দিয়ে হালচাষ করি। এতে সময় বেশি লাগলেও আমরা পুরোনো পদ্ধতিটি ধরে রেখেছি।
উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের জয়রামপুর নওদাপাড়ার রমজান আলী বলেন, কালের বিবর্তনে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হালচাষ দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কাক ডাকা ভোরে কৃষকরা লাঙ্গল কাঁধে এক জোড়া গরু/মহিষ নিয়ে বেরিয়ে যেত মাঠের জমিতে হালচাষ করার জন্য। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমিতে কৃষকের লাঙ্গল দিয়ে হালচাষ, সঙ্গে ভাটিয়ালি-পল্লীগীতি গানের মধুর সুর মাতিয়ে রাখতো হাট-ঘাট ও মাঠ। কৃষাণীরা সাজিয়ে নিয়ে যেতেন সকালের নাস্তা পিয়াজ কাঁচা মরিচ দিয়ে পান্তাভাত ও দুপুরে গরম ভাত। কৃষাণীদের সকালের পান্তাভাত নিয়ে যেতে দেরী করলে কৃষকেরা রসিকতার গান ধরতো ‘এতো বেলা হয় ভাবীজান পান্তা নাই মোর পেটে… রে…’। এটাই ছিল গ্রামবাংলার কৃষাণ-কৃষাণীর চিরাচরিত অভুতপূর্ব দৃশ্য। এখন এমন নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়ে না বললেই চলে।
হাউলী ইউনিয়নের তারিনীপুর গ্রামের হারেজ আলী বলেন, এবারও আমার জমি গরু দিয়ে হালচাষের মাধ্যমে আবাদ করেছি। এলাকার সবাই এ পদ্ধতি বাদ দিলেও আমি ধরে রেখেছি। সামনের দিনেও এভাবে হালচাষ করে যাব।
এছাড়াও উপজেলার আব্দুর রহমান, লুৎফর রহমান,আলী হোসেন, জয়নাল হোসেনসহ আরো কৃষকরা জানান, গরুর লাঙ্গল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪৪ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। আধুনিক যন্ত্রপাতির থেকে গরুর লাঙ্গলের চাষ গভীর হয়। জমির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার, কীটনাশকের সাশ্রয় হয়। কষ্ট হলেও গরু দিয়ে হাল চাষ করতে খুব ভাল লাগত। এখন মনে পড়লেই কষ্ট হচ্ছে। ফিরে পাবনা আর সেই পুরনো দিনগুলো। এভাবেই ধিরে ধিরে হারিয়ে যাবে আমাদের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য।
দামুড়হুদা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, গরু-মহিষের পরিবর্তে কলের লাঙলের চাষাবাদে সময় কম লাগে, উৎপাদনও বেশি হয়। এ উপজেলার প্রায় শতভাগ জমি এখন যান্ত্রিক উপায়ে চাষ হয়।
দিন বদলাচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের জীবনধারা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে পাল্টে যাচ্ছে সব কিছুই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে কৃষকদের জীবনেও এসেছে নানা পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়াও লেগেছে কৃষিতে। তাইতো কাঠের লাঙ্গলের পরিবর্তে এসেছে ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার।