অনলাইন জুয়ার মাস্টার এজেন্ট মাহফুজুর রহমান নবাব আটকের পর থেকে রাশিয়ান জুয়া সাইট ওয়ান এক্সবেট বাংলাদেশে বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। এখন তারা মেইলবেট ও লাইনবেট সাইটের মাধ্যমে জুয়ার লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছেন। মেহেরপুর পুলিশের ধারাবাহিক অভিযানের ফলে অনেক জুয়াড়ি গা ঢাকা দিয়েছেন। কৌশলে জেলার বাইরে থেকেও লেনদেন চালিয়ে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি অনলাইন জুয়ার সংবাদ প্রকাশ ও পুলিশের অভিযান শুরু হওয়ার পর মেহেরপুর প্রতিদিনের সাথে যোগাযোগ করেন ক্ষতিগ্রস্থ এক অনলাইন জুয়ার এজেন্ট। তিনি মেহেরপুর প্রতিদিনকে দেওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারে দুর্লভ কিছু স্বীকারোক্তি দেন। স্বীকারোক্তিতে যাদের নাম জানান, তাদের নাম এখনো পর্যন্ত কোন সংবাদে কিংবা পুলিশের তালিকায় উঠে আসেনি। ওইসকল নামগুলো যাচাই বাছাইয়ে মেহেরপুর প্রতিদিনের অনুসন্ধান চলছে। অনলাইন জুয়ার এ সকল মাস্টারমাইণ্ডরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে দেদারছে বুকফুলিয়ে জুয়া চালিয়ে যাচ্ছেন।
তার স্বীকারোক্তী থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালে করোনাকালীন সময়ে মূলত কয়েকজন অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। তারা হলেন- কোমরপুর গ্রামের মুকুল ইসলাম, নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার, নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার এদের অন্যতম। আমাদের আজকের পর্বে থাকবে এই চারজনকে নিয়ে যারা অনলাইজন জুয়ার মূল হোতা। তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে অনলাইন জুয়ার দূর্গ। তারাও হয়েছেন কোটিপতি। এদের রয়েছে প্রায় দু’ডজন এজেন্ট। যারা এই চারজনের চ্যানেল নিয়ে নিয়মিত অবৈধ ট্র্যানজেকশন করে চলেছেন।
মেহেরপুর প্রতিদিনের কাছে এসকল এজেন্টদের নাম ও পরিচয় এসেছে। পরবর্তিতে সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ করা হবে। ওই এলাকার এক তরুণ ইতোমধ্যে রাশিয়া গিয়ে লাইনবেট অফিসের মাধ্যমে পুরো অনলাইন জুয়া নিয়ন্ত্রণ করছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
আরও পড়ুন মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার দূর্গে হানা
চার হোতাদের মধ্যে নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার ও নুরুল ইসলাম মাস্টার দুজনই মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। কিন্তু কলেজটি এখনো এমপিও ভুক্ত হয়নি। তারা দুজনই মুকুল ইসলামের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। অপরদিকে, মাদার মাস্টার নিজেই এ অনলাইন জুয়ার হোতা হয়ে উঠেছেন।
নুরুজ্জামান মাস্টার ঢাকার একটি গার্মেন্টেসে চাকরি করতেন। চাকরি ছেড়ে তিনি নিজ গ্রামে চলে আসেন। কলেজ শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি নবাব ও মুকুলের মাধ্যমে অনলাইন জুয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এর পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কোমরপুর বাজারে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। মূলত অনলাইনের লেনদেনগুলো যেন তার ব্যাংকে থেকেই করতে পারেন। পাশাপাশি কেউ যেন সন্দেহ করতেও না পারেন তাকে। কোথায় থেকে এত টাকা মালিক হচ্ছেন। বছর তিনেক আগে মাটির ঘরে বসবাস করলেও বর্তমানে আলিশান বাড়ি তৈরি করেছেন। ব্যবহার করেন দামি মোটরসাইকেলও। কয়েক মাস আগে তাকে পুলিশ তুলে নিয়ে এসেছিলো। অজানা কারণে তাকে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে।
তবে মাস খানেক আগে তার ব্যাংকে গিয়ে তার সাথে কথা বলে মেহেরপুর প্রতিদিনের একটি টিম। তিনি বলেন, জুয়া কি জিনিস আমি জানি না। কিভাবে বা কারা এসব খেলে তাও জানিনা। কিন্তু বিভিন্ন জন এই ব্যাংক দেওয়ার পর থেকে আমাকে জুয়ার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে। এর আগে পুলিশও আমাকে সন্দেহ করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো বলে তিনি স্বীকারও করেন।
নুরুল ইসলাম মাস্টার গরিব ঘরের সন্তান। তিনি মুজিবনগর আদর্শ কলেজের শিক্ষক। তিনিও জড়িয়ে পড়েন অনলাইন জুয়ায়। শুরু করেন লাইনবেট অনলাইন জুয়ার এজেন্ট হিসেবে। পরবর্তিতে তিনি কেদারগঞ্জ বাজারে সিটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়েছেন। তার পাশে মার্কেন্টাইল ব্যাংক নামের আরেকটি ব্যাংকের এজেন্ট নিয়েছেন। পরবর্তিতে আরো একটি ব্যাংকের এজেন্ট নেন। তিনি স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, কয়েকমাস আগে তিনি একই দাগে প্রায় কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন প্রায় কোটি টাকা দিয়ে। দুই তলা বিশিষ্ট বাড়িও করেছের নিজ গ্রামে। আর এ সবকিছুর উৎস অনলাইন জুয়া।
আরও পড়ুন মেহেরপুরে অনলাইন জুয়ার মাস্টারমাইণ্ড প্রসেনজিৎ সহযোগীসহ আটক
ওই দিন বিকালে মেহেরপুর প্রতিদিন টিমের সাথে জামান মাস্টারের কথা চলতে চলতে একই স্থানে হাজির হন নুরুল ওরফে লালন মাস্টার। তিনিও নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন। তবে কিভাবে ব্যাংকের এজেন্ট হলেন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এর আগে একটি চাকরি করতাম। আর ব্যাংক নিতে খুব বেশি টাকা লাগেনি।
মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার। তিনি কোমরপুরের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও সদর উপজেলার সাহেবপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান হিসেবে কর্মরত। অথচ কোটি টাকা খরচ করে ২তলা বিশিষ্ট রাজপ্রাসাদ বানিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১০ থেকে ১২টি লাইনবেট সাইটের এজেন্ট তিনি। তিনি নিজেও এই লেনদেনের সাথে জড়িত এবং তার ছেলে অনিক ঢাকা থেকে তার এসকল লেনদেন করে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ছেলে অনিক ঢাকায় বাসা ভাড়া করে অভিযাত জীবনযাপন করেন বলে জানা গেছে।
মাদার আলীকেও কয়েক মাস আগে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নেওয়া হয়েছিলো বলে পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে। পুলিশ সুপারের নামে স্থানীয় অনলাইন এজেন্টদের কাছে টাকা তোলার অভিযোগ ছিলো তার বিরুদ্ধে। অথচ বর্তমান পুলিশ সুপার রাফিউল আলম অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষনা দিয়ে তার বাহিনীকে মাঠে নামিয়েছেন।
তবে মাদার আলীর মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, তার ফোনে অপরিচিতরা কেউ ইনকামিং কল করতে পারেন না।
এই তিনজনই স্থানীয় প্রভাবশালী এক নেতার সানিধ্য থেকে নিজেদের বড় রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে দাবী করেন। এমনকি সুযোগ পেলেই জনপ্রতিনিধিদের সাথে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দিয়ে নিজেদের জানান দেন। অভিযোগ রয়েছে তাদের নাম যেন কোন সংবাদে না আসে কয়েকজনকে সাংবাদিককেও মাসোহারা দিয়ে থাকেন।
স্থানীয় কয়েকজন জানান, জামান মাস্টার ও নুরুল মাস্টারের অর্থনৈতিক অবস্থা হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছের মত হয়ে যাওয়ার মত হয়েছে। এবং মাদার মাস্টারের অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে এই তিনজনের আলাদিনের চেরাগ পাওয়ার মত অবস্থা হয়ে গিয়েছে।
অপরজন, মুকুল ইসলাম। তিনি অনলাইন জুয়ার মূল হোতা। তিনি কোমরপুর গ্রামের ইজারুল ইসলামের ছেলে। তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি ইনকামের নেশায় মাহফুজুর রহমান নবাবের সাথে অনলাইন জুয়া খেলায় জড়িয়ে পড়েন। পরবর্তিতে তার মাধ্যমে অনলাইন জুয়ার এজেন্ট চ্যানেল দিয়ে পুরো এলাকা অনলাইন জুয়ায় ছাপিয়ে দেন। বিভিন্ন জনের কাছে থেকে বিভিন্ন অংকের টাকা নিয়ে তিনি লাইনবেটের এজেন্ট বিক্রি করেন। এবং একই সঙ্গে নিজেও জুয়া খেলেন। অভিযোগ রয়েছে বিভিন্ন জনের কাছে থেকে তিনি চ্যানেল বিক্রির নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কিন্তু অনেককেই চ্যানেল দিতে পারেননি। তিনি নিজেও জুয়া খেলে চ্যানেল বিক্রির টাকা নস্ট করে সর্বশান্ত হয়েছেন। অন্যান্যরা কোটিপতি হলেও তিনি জুয়ায় হেরে ধীরে ধীরে নি:স্ব হচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে মুকুলের সাথে মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি জানান, এই প্রথম কোন সাংবাদিক কিংবা পুলিশ তার সাথে জুয়া নিয়ে কথা বললো। তিনি অকপটে স্বীকার করে বলেন, লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু একটা আয় করতে হবে এই নেশায় জড়িয়ে পড়িছিলাম। তবে আমি হতাশ। এই জীবনে অনেক সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারিনি। বরং আমি অনেকের কাছে থেকে টাকা ধার নিয়েছি জুয়া খেলার জন্য। এখন কেউ আমার ফোনটাও ধরতে চাই না। কয়েকদিন আগে আমার পরিবার জমি বিক্রি করে একজনকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছে। আপনার মাধ্যমে জামান মাষ্টার, নুরুল মাষ্টাররা এজেন্ট নিয়েছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি তাদের কিভাবে কি করতে হয় তাই শিখিয়ে দিয়েছি। কারণ আমি অনলাইন সম্পর্কে বুঝি এই জন্য। এর বেশি কিছ’ বলবো না। তবে তাছাড়া তারা কিভাবে এত টাকার মালিক হয়েছেন তাতো বুঝতেই পারছেন।
মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাইফুল আলম বলেন, অনলাইন জুয়ার সাথে জড়িত কয়েকজনকে আটকের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে অনেকের নাম পাওয়া গেছে। কোমরপুর গ্রামের কয়েকজন শিক্ষকের নামও পাওয়া গেছে। আমরা কাজ করছি। অনলাইন জুয়া অথবা অবৈধ ট্র্যানজেকশনের সাথে যারাই জড়িত থাকবে তাদের আইনের আওয়তায় আনা হবে।
(চলবে…)
এ সংক্রান্ত অনলাইন জুয়ার খপ্পরে মেহেরপুরের অর্ধশত তরুণ