“বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট, তোমরা একজন একজন করে এসো, নইলে ও মরে যাবে।” ১৩ শব্দের বাক্যে একজন মায়ের আকুতি কী আমরা ভুলে গেছি। সন্তানের উপর কোতোটা বরবর নির্যাতন হলে একজন মা এভাবে আকুতে জানাতে পারে? কিন্তু মায়ের চোখের জল আর গগন বিদারী আহাজারীতেও নরপিশাচদের এতোটুকু মন গলেনি।
পূর্ণিমা রাণী শীলের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপড়ায়। ২০০১ সালে পূর্ণিমার বয়স মাত্র তেরো বছর। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সে। গ্রামের ৮-১০টি কিশোরীর মতো উচ্ছল চঞ্চল প্রাণে বেড়ে উঠছিল। কিন্তু ১৩ বছর বয়সে, ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর তার জীবনে নেমে আসে কালো অন্ধকার। তছনছ করে দেয় তার তারুণ্যে ভরা জীবনকে। সেই রাতে পূর্ণিমার বাড়িতে হামলা চালায় বিএনপি-জামাতের নেতাকর্মীরা। এরপর পূর্ণিমা আর তার মা’কে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় বাড়ির পাশের একটি ক্ষেতে। পনেরো থেকে বিশজন বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডার ধর্ষণ করে কিশোরী পূর্ণিমাকে। মায়ের সামনেই মেয়ের ছোট্ট শরীরটার ওপর অত্যাচার চালিয়েছিল নরপিশাচের দল। কান্না করতে করতে পশুগুলোর কাছে মিনতি করছিলেন মা। বলছিলেন, “বাবারা, আমার মেয়েটা ছোট তোমরা একজন একজন করে এসো, নইলে ও মরে যাবে।”
ছবি রানীর বাড়ি বাগেরহাটের রামপালে। ২০০২ সালের ২১ শে আগস্ট তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট বাহিনীর নেতাকর্মীদের গণধর্ষণের শিকার হন তিনি। বাসস্ট্যন্ড থেকে ছবি রানীর কাপড় খুলে ফেলে বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডারবাহিনী। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বিএনপি অফিসে। এরপর পালাক্রমে তাকে ধর্ষণ করা হয়। নরপিশাচরা শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি, ছবি রানীর গোপন অঙ্গে মরিচের গুড়া, বালি আর কাচের গুড়া ঢুকিয়ে নির্যাতন করে।
২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর ভোলা জেলার চরফ্যাসন উপজেলায় বিএনপি নেতাকর্মীরা ২০০ হিন্দু নারীকে গণধর্ষণ করে। সবচেয়ে ছোট ভিকটিমের বয়স ছিল 8 বছর আর সবচেয়ে বড়টির বয়স ছিল ৭০ বছর। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সারাদেশে এমন কয়েকশ’ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। চক্ষুলজ্জা আর প্রাণের ভয়ে অনেক তা প্রকাশ্যে আসেনি। তাদের সবার অপরাধ ছিল, তারা ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং তারা বঙ্গবন্ধুর নৌকার সমর্থক।
২০০১ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর থেকেই সনাতন ধর্মালম্বীদের উপর হামলা শুরু হয়, যা চলে পরবর্তী পাঁচ বছর। বাগেরহাট, বরিশাল, ভোলা, বগুড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, ফেনী, গাজীপুর, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ, নাটোর, পিরোজপুর, সিরাজগঞ্জ, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ জেলায় হিন্দুদের উপর পরিকল্পিত হামলা হয়। দ্বীপ জেলা ভোলায় প্রায় দুই মাস ধরে ধর্মীয় সংখ্যালঘু পরিবারের উপর নির্যাতন চলে। যোগাযোগব্যবস্থা খারাপ থাকায় প্রশাসনের লোকজন এমনকি সংবাদকর্মীরাও নির্যাতনের সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি। সেসময় সারাদেশে বাড়িঘর লুটপাট, বাড়ি থেকে উচ্ছেদের মতো অজস্র ঘটনা ঘটে। এসবের অধিকাংশই পুলিশের নথিভুক্ত হয়নি। ভুক্তভুগীরা ভয়ে কোন অভিযোগ পর্যন্ত করেননি।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ১৯৯৬, ২০০১ বা তার আগের প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঠিক পরের বছরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ ও ধর্ষণ চেষ্টা বেশি। শুধু ব্যতিক্রম চিত্র দেখা যায় ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর। ১৯৯৬ এর নির্বাচনের বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২১৪টি, পরের বছরে ৫৫৪টি । ২০০১ সালে ধর্ষণের ঘটনা ৫৬৬টি হলেও পরের বছরে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯১টিতে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের বছরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৫৪৫টি, পরের বছরে এ সংখ্যা ছিল ৬৯০। ২০১৮ সালে নির্বাচনের বছরে ধর্ষণের ঘটনা ৫৫৬টি, পরের বছরে তা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭টিতে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন দায়ের করে। হাইকোর্ট এক আদেশে নির্যাতনের ঘটনা তদন্তে একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ দেন। এক বছরের বেশি সময় তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল সরকারকে ৫ খণ্ডের ১ হাজার ১০০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। প্রতিবেদনে দোষীদের চিহ্নিত করা এবং নির্যাতন প্রতিরোধে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়। পরবর্তী সময়ে এই প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশের নির্দেশনা চেয়ে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ হাইকোর্টে আরেকটি রিট দায়ের করলে আদালতের নির্দেশ মোতাবেক প্রতিবেদন ২০২২ সালের ১ এপ্রিল গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।
তদন্ত কমিশনের ওই প্রতিবেদনে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় ঢাকায় ২৭৬টি, চট্টগ্রামে ৪৯৭টি, সিলেটে ১৭টি, খুলনায় ৪৭৮টি, রাজশাহীতে ১৭০টি এবং বরিশালে সর্বাধিক ২ হাজার ২২৭টি ঘটনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯২টি হত্যা, ১৮৪টি ধর্ষণ-সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনারও উল্লেখ আছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বারবার ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা কেন নিযাতনের শিকার হন? বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগ। নির্বাচনের মাঠে এই ১০ ভাগ ভোটারই জয় পারাজয়ে অনেক বড় একটা ভূমিকা পালন করে। সংখ্যালঘু ভোটারদেরকে বলা হয়, আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক। যদিও গবেষণায় দেখা যায়, সংখ্যালঘু ভোটাররা সব সময় যে একটা দলের পক্ষে ভোট দিয়েছে বা আনুগত্য প্রকাশ করেছে বিষয়টি এমন নয়। বাংলাদেশের বিভক্ত রাজনীতিতে সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোটও বিভক্ত হয়ে পরে এবং কোন দলের প্রতি তাদের সমর্থনও প্রত্যাহার করে। সুতরাং সংখ্যালঘু ভোটার মানেই আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক এই বাস্তবতা সত্য নয়। কিন্তু বিএনপি-জামায়াতের প্রথম হামলার শিকার হন ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে আওয়ামী নেতৃত্ব মুছে ফেলা এবং যুদ্ধপরাধীদের পুনর্বাসনের মাধ্যমে পাকিস্থানের পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশ থেকে সনাতন ধর্বলম্বীদের সমূলে উৎখাতের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে জামায়াত-বিএনপি জোট। তাই প্রতিবার নির্বাচনে তারা হারলে বা জিতলেও সবচেয়ে বড় আক্রোশ মিটিয়েছে হিন্দুদের নির্যাতন, ধর্ষণ আর দেশ থেকে থেকে বিতাড়িত করে।
তবে এখন আর ভয় পাওয়ার সময় নেই। রুখে দিতে হবে নরপশুদের। আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেদের দাঁড়াতে হবে। কারণ এই দেশটি সবার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আশ্বস্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘নিজেদের সংখ্যালঘু মনে না করে, মনে করবেন আপনারা এই দেশেরই নাগরিক। সমান নাগরিক অধিকার আপনারা ভোগ কখনো নিজেদের মনে হীনম্মন্যতা নিয়ে আসবেন না।’
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।