ধর্ষণ এখন যেন মহামারীতে রুপ নিয়েছে। ধর্ষণ মহামারি যেন করোনা ভাইরাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। ধর্ষণ এখন একটি নিত্যদিনের ঘটনা মনে হচ্ছে।
প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই চোখে পড়ে কোথাও না কোথাও কোনো নারী, কোনো কিশোরী , কোনো শিশু ধর্ষিত হয়েছে।
টেলিভিশনের স্ক্রলে দশ মিনিট ধরে ধর্ষনের সংবাদ। কোন জেলায় কত জন ধর্ষণ হয়েছে। কোন জেলায় কত কম বয়সী শিশু ধর্ষণ হয়েছে। এ যেন অসভ্য জাতির নির্লজ্জ কর্মকান্ডের বহিঃপ্রকাশ।
ধর্ষণ কেন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে, তার কারণ অনুসন্ধান জরুরি। অপরাধবিজ্ঞানী, সমাজকর্মীরা গভীর অনুসন্ধান, গবেষণা করলে হয়তো ধর্ষণের প্রকৃত কারণ বের করতে পারবেন।
তবে, ধর্ষণের কিছু কারণ সাধারণ নাগরিকের খালি চোখেও ধরা পড়ে। যদিও এদের মধ্যে মতবিরোধ, বিভক্তি রয়েছে। একপক্ষ ধর্ষণের জন্য কেবল পুরুষকে দায়ী করছে, অন্যপক্ষ দুষছে নারীর পোশাককে। প্রথম পক্ষের অভিযোগে সিংহভাগ সত্যতা মিললেও দ্বিতীয়পক্ষের দাবি ষোলো আনাই অন্তঃসারশূন্য; এর কারণও স্পষ্ট।
পোশাক নাকি মানসিকতা দায়ী, তার বিচার করতে হলে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়। আচ্ছা, বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময়ই উঠে আসে। শুধু বাংলাদেশেই নয়, আরও বহু দেশে শিশু ধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু শিশু ধর্ষণ হয় কেন? শিশুরা মিনি স্কার্ট পড়ে থাকে বলে ? শিশু বাচ্চাদের দেখেও কী মনের মধ্যে কামনার সৃষ্টি হয়? তাহলে কী জন্মের পর থেকেই শিশু বাচ্চাদের পা পর্যন্ত আলখেল্লা পড়িয়ে রাখতে হবে? নাকি নিজের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে?
৭১ এর যুদ্ধে পাকিস্তানিরা এবং রাজাকাররা যে হাজারো মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে , এ সব কী পোশাকের কারণে? ৭১ এ কী তারা মিনি স্কার্ট পরে ঘুরে বেড়াতো ? নাকি নিজেদের ভোগী মানসিকতার খোরাক মিটাতে জানোয়ারগুলো ধর্ষণ করতো?
পোশাকই যদি ধর্ষণের মূল কারণ হবে, তাহলে আরব দেশগুলোতে কেন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেখানে সবাই বোরখা পড়া? খারাপ মানসিকতা সৃষ্টির জন্য আপনি নারীর অর্ধনগ্ন পোশাককে দায়ী করছেন?
একটু পিছনে ফিরে তাকায়, তনুকে যখন ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো , তখনো বাংলাদেশের ধর্মান্ধরা অপপ্রচার চালিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলো যে তনুর ধর্ষণের জন্য তনুর পোশাকই দায়ী।
কিন্তু তনুর ছবিগুলো তখন সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে সে বোরখা পরিহিতা ছিল। কতটা নির্লজ্জ মানসিকতা হলে একটি মৃত মেয়ের উপর মিথ্যে দোষ চাপানো যায় ভাবতে পারেন? কিংবা কিছু দিন আগে যে ছয় বছরের শিশু আছিয়াকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হলো তার কথাই বা কী বলবেন? আছিয়ার ক্ষেত্রেও কি পোশাকের দোষ? এমন নিচ মানসিকতার বলেই তো ধর্ষণ সম্ভব, পোশাকের কী দোষ!?
নারী ধর্ষণে যদি পোশাকে ত্রুটি খোঁজেন তাহলে কোলের শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মহিলা, কিশোরী, রাস্তার ধারের মানসিক ভারসাম্য হারানো কিছু না বোঝা মেয়েটি সহ কেউই রেহাই পাচ্ছে না ধর্ষণের হাত থেকে। ঘরে-বাইরে সব জায়গায়ই যেন যৌনতার আশায় নারীকে ভোগ করার লালসায় থাকছে পুরুষরা। তারা যেন জঙ্গলের হিংস্র পশুর চেয়ে বেশি ক্ষুধার্ত হয়ে ঘুরছে আমাদের চারপাশে। আর তাদের ক্ষুধা রক্ত-মাংসে গড়া নারীর শরীরের প্রতি।
কখনো এই ধর্ষণের পেছনে থাকছে চেনামুখের অচেনা হিংস্রতা কখনো-বা অচেনা মুখের হিংস্রতা! তাদের লালসা মেটানোর সময় সামনে কাকে ভোগ করছে, সেটা ভাবার সময়ও তাদের নেই। সম্পর্কে হতে পারে বাবা মেয়ে।
যেন এই সমাজ এবং রাষ্ট্র এক ধর্ষণের মহামারী আকার ধারণ করছে। নারীর মূল্যবান সম্পদ সতীত্বকে হরণ করে সমাজে নারীর সম্ভ্রম হারিয়ে ও সামাজিকভাবে নারীকে হেও প্রতিপন্ন করার পৈশাচিক খেলায় মত্ত হয়েছে পুরুষ।
ধর্ষণ এই ছোট শব্দটির অর্থ এতটাই বড় বিশাল।যে এর গ্লানি বর্ণনা করলে সারা জীবনেও শেষ হবেনা।বা শব্দটির ক্ষতিপুরনও সম্ভব না।ধর্ষণ একটি অমার্জনীয় অপরাধ। এটি একজন মানুষকে খুনের অপরাধের চেয়েও কম বলে বিবেচিত হওয়া উচিত নয়।
আজকাল হাতের মুঠোয় স্মার্ট ফোনের কল্যাণে পর্ন দেখছে। স্বপ্নে পর্ন নায়িকার সাথে যাচ্ছে স্বপ্নসর্গে । বাস্তবে তার দেখা নেই। এসবের কারণে, মানুষ সঠিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। পর্ন দেখা বা মেয়ে মানুষের শরীর পাওয়া একেবারেই অসামঞ্জস্য থেকে তাদের বানিয়ে দিচ্ছে ‘ধর্ষক’। তাদের ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই বললেই চলে। অথচ ধর্ষণ করে খুন করতে দ্বিধাগ্রস্ত হচ্ছে না।এদের কাছে মেয়ে মানুষ যে বয়সেরই হোক না কেন তারা শুধু একটি ‘অবজেক্ট’। মানুষ নয়। তাদের মাথায় একটাই পোকা নারী মাত্রই ভোগের সামগ্রী। তাদের ভোগ করো, খুন করো, অত্যাচার করো।তা যে বয়সেরই হোক না কেন। কোনও ব্যাপার না।
আমাদের অন্যায্য সমাজে ধর্ষকরা নন্দিত, ধর্ষিতারা নিন্দিত।ধর্ষণের সমস্ত দায় ভার, সমস্ত লজ্জা,অপমান আর উপহাস ধর্ষিতার উপর।
ধর্ষণ ধর্ষিতার মেধা,বল,আশা,স্বপ্ন, লক্ষ্য ও সম্ভ্রমকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। শারীরিক ধর্ষণের পর ধর্ষিতার শুরু হয় মানসিক ধর্ষণ।পত্রিকার পাতায় কলামে,থানায় পুলিশের ডায়েরীতে,আদালতে উকিলের অসভ্য জেরায়।দিনের পর দিন ধর্ষিত হয় পাড়ার বুড়োদের চায়ের আড্ডায়,ছোড়া ছোকড়াদের মুখে মুখে কিংবা পাড়াতো বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানে। ধর্ষিতা শিশু, কন্যা নারীরা বেঁচে গেছে তাই অবহেলা করে মা বাবা। ভাই বোনেরা ঘৃণা করে।পাড়া প্রতিবেশিরা দিনের পর দিন তার চরিত্রের কুলশতা এবং পঙ্কিলতা নিয়ে খোটা দেয়।ধর্ষিতা মেয়েটার সঙ্গ ত্যাগ করে বান্ধবীরা।জীবনটা বিভীষিকা বানিয়ে দেয়।আর ধর্ষক কলার উঁচু করে ঘুরে বেড়ায়।চায়ের দোকানে বিড়ি ফু্ঁকে কিংবা অলিতে গলিতে বন্ধুদের সাথে ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে থাকে ধর্ষণের সময় সে কী কী করেছে।ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে ইরোটিক সুখ অনুভব করে।
ধর্ষিতার ধর্ষণ যেন দান্তের নরকে প্রবেশের ওয়ান ওয়ে টিকিট। আত্মহত্যা না করলে আমরণ হেঁটে যেতে হবে নরকে।জলজ্যান্ত নরক থেকে মুক্তির আশায় অনেক ধর্ষিতা মেয়েই আত্মহনন বেছে নেই।
নারী যদি ছালার বস্তা পরে ঘরের কোণায়ও বসে থাকে পুরুষের শকুন চোখ বস্তার ফাক ফোকর দিয়ে দেখে নিবে নগ্ন শরীর।এই সব শকুনের চোখ উপড়িয়ে ফেলতে হবে সমাজ থেকে।
আমি কোন ধর্ষকের বিচার চাইনা কারণ কারও বিচার হয়নি।বিচার হয়নি আড়াই বছরের শিশু, আফসানা,বিচার হয়নি তনুকিংবা বিউটি কারও শেষ পর্যন্ত বিচার হয়নি।বিচার হবেও না আছিয়ার।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি আর সম্ভ্রমহীনতার সনদ বোঝা নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে এরা।শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে বিচার।
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক