মুক্তিযুদ্ধের পর মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিল ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে উদীয়মান অর্থনীতির রোল মডেল। যাঁর নেতৃত্বে আজ বাংলাদেশের এই বিস্ময়কর উত্থান, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার পথচলার এ দীর্ঘ সময় কখনোই সহজ ছিল না। ২১ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছে স্বাধীনতাবিরোধীরা। তাছাড়া নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে শক্ত হাতে পূর্ণ আত্মবিশ্বাসে আজও বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে ফেরাই ছিল শেখ হাসিনার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তৎকালীন স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে বাধা দেয়। ফলে রাজনৈতিক আশ্রয়ে বাধ্য হয়ে ভারতে অবস্থান করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু বাংলার মানুষের ভালোবাসায় তৈরি হয়েছে শেখ হাসিনার সাহসের পাটাতন। পরবর্তীতে সামরিক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি ফিরে আসেন স্বদেশে। মুখোমুখি হন স্বৈরাশসকের।
১৯৭৭ সালে ভারত সফরের সময় জিয়াউর রহমান শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় না দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন তৎকালীন ভারত সরকারকে। ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ইন্ডিয়ান টাইমসে এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন সে সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭৫-৮১ ছয় বছর বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়ে অবশেষে ১৯৮১ সালের ১৭ মে সকল রক্তচক্ষুকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। শুরু করেন বাংলার মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার আন্দোলন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগ। অনেকেই আওয়ামী লীগ ছেড়ে মোশতাকের মন্ত্রীসভায় যোগ দিয়েছিল সে সময়। সারাদেশে স্বৈরশাসক জিয়ার অত্যাচার নিপীড়নে ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সে অবস্থা থেকে দলের পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেন শেখ হাসিনা। কয়েক বছরের মধ্যেই শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শুরু হয় আওয়ামী লীগের পুনর্জাগরণ।
সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পতনের পর শুরু হয় স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামল, চলে ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। স্বৈরাশাসক হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এসময় দেশের গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে, পূর্ববর্তী সেনাশাসক জিয়ার মতই একচেটিয়া শাসনব্যবস্থায় দেশ পরিচালনা করতে থাকে। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে তীব্র আন্দোলনের মুখে পিছু হটতে শুরু করে এরশাদ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নানামুখী আন্দোলনের মুখে পতন ঘটে স্বৈরাচার এরশাদের শাসনব্যবস্থা। পুনরুদ্ধার হয় গণতন্ত্রের। এজন্যই তাঁকে বলা হয় ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’।
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদের উত্থানের আলামত প্রথম স্পষ্ট হয় ১৯৯২ সালে বিএনপি শাসনামলে। সে সময় বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী জঙ্গিরা ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান’ স্লোগান তুলেছিল। শুধু তাই নয়, বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীলীগ নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে জঙ্গীদের দিয়ে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। সারাদেশে একযোগে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলা করে মানুষ হত্যা করা হয়েছিল। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে জঙ্গীবাদের সকল আস্ফালন বন্ধ করে দেন। আইন প্রয়োগের মাধ্যমে জঙ্গীদের বিচারের আওতায় আনেন। গ্রেনেড হামলা, সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত সকলের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করেন। ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজানে আকস্মিক হামলার পরে শেখ হাসিনা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সর্বস্তরের মানুষ শেখ হাসিনার এ পদক্ষেপে সহযোগিতা করেন। ফলাফল সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে এক রোল মডেল ।
২০০১-২০০৬ বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সময় দেশের প্রশাসনিক কাঠামো একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিল। ২০০৮ সালে নবগঠিত আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পরিকল্পিতভাবে তৎকালীন কিছু বিপথগামী বিডিয়ার সদস্যরা বিদ্রোহ ঘটানোর সঙ্গে জড়িত ছিল। শেখ হাসিনা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সে বিদ্রোহ দমন করেন। বিচক্ষণতার সাথে বিদ্রোহ দমনের লক্ষ্যে প্রথমে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেন, তদন্ত কমিটি গঠনের মাধ্যমে বিদ্রোহের প্রকৃত সত্য উন্মোচন করেন এবং বিদ্রোহে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনেন। ভবিষ্যতে বিডিআর কর্তৃক এ ধরনের ঘটনা যেন দেশকে বিপদের মুখে ফেলতে না পারে এবং বিডিয়ার বাহিনী যেন কলঙ্কিত না হয়, সেজন্য নতুন আইন প্রণয়ন করেন শেখ হাসিনা সরকার। বিডিয়ারের নাম পরিবর্তন করে বিজিবিতে (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) উন্নীত করেন। বিজিবি’র সার্বিক কল্যাণে বিজিবি কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন এবং ‘সীমান্ত ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন। বিজিবিতে নতুন ৪টি সেক্টর ও ১৭টি ব্যাটেলিয়ন তৈরি করেন। সর্বনিম্ন পদ থেকে সুবেদার মেজর পর্যন্ত সদস্যদের সীমান্ত ভাতা প্রদান, অগ্রিম বেতনসহ দু’মাসের ছুটি ভোগের সুবিধা, রেশন, চিকিৎসা ও আবাসন সুবিধা বৃদ্ধি করেন।
বাংলার হাজার বছরের সম্প্রীতির সংস্কৃতি ধ্বংস করতে ৭৫ সালের পর থেকেই চলছে পরিকল্পিত চক্রান্ত এবং আঘাত। নানা সময়ে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করেছে সাম্প্রদায়িক অপগোষ্ঠী। রামু, নাসিরনগর, কুমিল্লা, রংপুরের সাম্প্রদায়িক আস্ফালন এর প্রকৃত উদাহরণ। কিন্তু শেখ হাসিনা শক্তহাতে এ সাম্প্রদায়িক আস্ফালন বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীসহ সর্বস্তরের সর্বধর্মের মানুষের সহায়তায় সাম্প্রদায়িকতা বন্ধের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রতিটি ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় এনে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়ার কাজ করে যাচ্ছেন নিরলসভাবে।
শুধু তাই নয়, করোনার কারণে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ধুঁকছিল, তখনও বাংলাদেশ রেকর্ড ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছিল। প্রয়োজনীয় সময়ে লকডাউন ঘোষণা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, টিকা আমদানি ও তা সঠিকভাবে প্রয়োগ, করোনা যুদ্ধে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের জন্য পিপিই-মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী নিশ্চিত করা; টেস্টিং কিট আমদানি, দেশের বিভিন্ন স্থানে ল্যাব স্থাপন, স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শের জন্য ৩টি হটলাইন (১৬২৬৩; ৩৩৩ ও ১০৬৫৫) চালুসহ প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপই সঠিক সময়ে গ্রহণ করেছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর গৃহীত বাস্তবসম্মত নানা পদেক্ষপের কারণেই বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় বিশ্বে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় শেখ হাসিনার নির্দেশনায় বর্তমানে ২২০টি ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্র, ৪২৩টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র, ৬৬টি ত্রাণ গুদাম, ২৬৯২ কি.মি. মাটির রাস্তা এইচবিবিকরণ, ৬৪৯১টি সেতু/কালভার্ট এবং ৫৫০টি মুজিব কিল্লা সংস্কার ও নির্মাণ করা হয়েছে ।
আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সাথে সামলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত বাংলাদেশের বিরোধ ছিল। শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক আইনের মাধ্যমে কোনরকম রক্তপাত ছাড়াই সমুদ্রসীমা বিরোধ সমাধান করেন। একই সাথে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ কিলোমিটার সমুদ্রসীমার ওপর সার্বভৌম অধিকার ছিনিয়ে আনেন। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রশংসিত হয়। চীন ও ভারতের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থাকলেও শেখ হাসিনা অত্যন্ত চমৎকারভাবে দুই দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, জাপানসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। শেখ হাসিনার কূটনৈতিক সফলতায় বাংলাদেশ এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব যখন নিষেধাজ্ঞাসহ দেশের সংবিধান পরিপন্থী নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার পাঁয়তারা করছে, শেখ হাসিনা তখন দেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন পরিচালনা করার দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে যাচ্ছেন। কোন অবস্থাতেই পশ্চিমা বিশ্ব শেখ হাসিনার এই গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অবস্থান থেকে টলাতে পারছে না। ফলে ভূ-রাজনীতির সমীকরণে শেখ হাসিনাকে বিগ ফেক্টর হিসেবে গণ্য করছে বিশ্বনেতারা।