মার্চের ১০ তারিখ সন্ধ্যা থেকে নিখোঁজ রয়েছেন ফটো সাংবাদিক ও ‘পক্ষকাল’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল। তখন থেকে তার ব্যবহৃত ফোন নম্বরটিও বন্ধ রয়েছে। তবে নিখোঁজের ঠিক ৩০তম দিনে (৯ এপ্রিল) সাংবাদিক কাজলের ফোন নম্বরটি চালু হয়েছিল যশোরের বেনাপোলে। ওইদিনই ফোন নম্বরটি বন্ধ হওয়ার পর কেটে গেছে আরও ১০ দিন। এরপর তদন্তে আর কোনও অগ্রগতি নেই।
তদন্ত কর্মকর্তা চকবাজার থানার এসআই মুন্সী আবদুল লোকমান জানান, সপ্তাহখানেক আগে নিখোঁজ সাংবাদিক কাজলের ফোন নম্বরটি চালু হয়েছিল। লোকেশন দেখিয়েছে বেনাপোল। করোনা পরিস্থিতির কারণে ও নম্বরটি চালু থাকার সময় কম হওয়ায় বেনাপোলে কোনও অভিযান চালানো সম্ভব হয়নি।
এরপর চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদারের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে ভালো কোনও আপডেট নেই।’ বেনাপোলে সাংবাদিক কাজলের মোবাইল নম্বরটি চালু হওয়ার বিষয়ে প্রতিবেদক জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘এমন তো কেউ জানায়নি।’ বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদকের সঙ্গে ফোনে কথা বলা অবস্থাতে পাশেই থাকা একজনের কাছে ওসি জানতে চান, ‘সাংবাদিক কাজলের ফোন চালু হয়েছিল কিনা।’ এরপর ওসি মওদুত হাওলাদার বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদককে বলেন, ‘বেনাপোলে ফোন ও সিম একসঙ্গে চালু হয়েছিল। আমরা বিষয়টা দেখছি।’
বেনাপোলে নিখোঁজ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ফোন নম্বরটি চালু হওয়ার পর যশোর জেলা পুলিশের সঙ্গে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা কোনও যোগাযোগ করেছিল কিনা, এ বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ওসি মওদুত হাওলাদার ‘তদন্তের স্বার্থে’ মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
হাতিরপুল থেকে নিখোঁজ কাজল
সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল ১০ মার্চ সন্ধ্যায় ‘পক্ষকাল’ ম্যাগাজিনে অফিস থেকে বের হন। এরপর থেকে তার কোনও সন্ধান না পেয়ে নিখোঁজের পরদিন ১১ মার্চ চকবাজার থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তার স্ত্রী জুলিয়া ফেরদৌসি নয়ন। ১৩ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে শফিকুল ইসলাম কাজলকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত দেওয়ার দাবি জানায় পরিবার। নিখোঁজের সাতদিন কেটে গেলেও কাজলের কোনও সন্ধান দিতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ১৮ মার্চ প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচির মাধ্যমে সাংবাদিক কাজলের সন্ধান চাওয়া হয়।
১৮ মার্চ অপহরণের অভিযোগে মামলা
১৮ মার্চ রাতে সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে অপহরণ করা হয়েছে অভিযোগ এনে চকবাজার থানায় মামলা করেন তার ছেলে মনোরম পলক। মামলার এজাহারে বলা হয়, ‘পক্ষকাল অফিসের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আমার বাবা তার অফিস থেকে গত ১০ মার্চ ৬টা ৪৮ মিনিটে মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন। তারপর থেকে তার আর কোনও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। আমার বাবা ফেসবুকে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে লেখালেখি করার কারণে ১০ মার্চ আড়াইটা থেকে যে কোনও সময় বকশীবাজার বাসার সামনে থেকে বা হাতিরপুলের অফিসের সামনে থেকে অজ্ঞাতনামা আসামিদের দ্বারা অপহৃত হন।’
সাংবাদিক কাজল নিখোঁজ হওয়ার পর তার সন্ধানের দাবিতে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে কয়েকদফা কর্মসূচি পালন করেছেন সাংবাদিক সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার উদ্বেগ
নিখোঁজের পর গত ১৪ মার্চ সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলকে খুঁজে বের করতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে নিউ ইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এক বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মানুষ অপহরণ ও গোপন স্থানে আটক রেখে নির্যাতনের অভিযোগ থাকায় কাজলের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা গভীর উদ্বেগজনক।
সাংবাদিক নিখোঁজের ঘটনায় দুই দফা উদ্বেগ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। প্রথম দফায় ২১ মার্চ ও দ্বিতীয় দফায় ১ এপ্রিল নিজেদের উদ্বেগের কথা জানায় সংস্থাটি।
দ্বিতীয় দফায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলে, সিসিটিভি ফুটেজে তার সর্বশেষ অবস্থান প্রকাশের তিন ঘণ্টা পর সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে কঠোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে একটি নতুন মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ঘটনা তার গুম হওয়ার আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
অ্যামনেস্টির বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ৫০ বছরের শফিকুল ইসলাম কাজল একজন ফটোগ্রাফার এবং দৈনিক পক্ষকালের সম্পাদক। আরও ৩১ জনসহ তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পুলিশের মামলার একদিন পর ২০২০ সালের ১০ মার্চ থেকে তার আর কোনও খোঁজ মিলছে না। নিখোঁজের আগের দিন ২০২০ সালের ৯ মার্চ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এমপি সাইফুজ্জামান শিখর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে শেরে বাংলা থানায় শফিকুল ইসলাম কাজল এবং আরও ৩১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে এ মামলা করা হয়।
পরদিন ১০ মার্চ বিকাল ৪টা ১৪ মিনিটে মোটরসাইকেলে শফিকুল ইসলাম কাজল ঢাকার হাতিরপুলে মেহের টাওয়ারে তার অফিসে পৌঁছান। এরপর তিনি ঘটনাস্থল ত্যাগের আগ পর্যন্ত তার বাইকের আশপাশে বেশ কয়েকজনকে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়। বিকাল ৫টা ৫৯ মিনিট থেকে ৬টা ৫ মিনিটের মধ্যবর্তী ৬ মিনিট তিন জন ব্যক্তি আলাদা আলাদাভাবে মোটরবাইকটির কাছে যান। ৬টা ১৯ মিনিটে কাজলকে অন্য একজন ব্যক্তির সঙ্গে অফিস থেকে বের হয়ে নিজের বাইকের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে দেখা যায়। পরে তিনি ফিরে আসেন এবং সন্ধ্যা ৬টা ৫১ মিনিটে বাইকে চড়ে চলে যান। এটাই ছিল তাকে প্রকাশ্যে সর্বশেষ দেখা যাওয়ার মুহূর্ত।
এর প্রায় তিন ঘণ্টা পর ১০ মার্চ রাত ১০টা ১০ মিনিটে তার বিরুদ্ধে একটি নতুন মামলা নথিবদ্ধ করে পুলিশ। উসমিন আর বেইলি নামের আওয়ামী লীগ দলীয় একজন সদস্য তার বিরুদ্ধে মামলাটি করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৬ ও ২৯ ধারায় মামলাটি করা হয়।
অনলাইনে মানববন্ধন ও কাজলের তোলা ছবির প্রদর্শনী
ফটো সাংবাদিক কাজলের সন্ধান দাবিতে গত ৮ এপ্রিল থেকে ১৬ এপ্রিল অনলাইন মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। whereiskajol হ্যাশট্যাগে চলে ক্যাম্পেইন। একই দাবিতে ১৬ এপ্রিল শফিকুল ইসলাম কাজলের তোলা ছবির অনলাইন প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
১৬ এপ্রিল রাত ১১টায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে ফেসবুক লাইভ করা হয়। ‘কাজল কোথায়?’ শিরোনামে আয়োজন করা লাইভে বক্তব্য রাখেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, শিল্পী ও মানবাধিকারকর্মী অরূপ রাহী, লেখক ও পরিচালক আশফাক নিপুণ এবং আলোকচিত্রী ও রাজনীতিবিদ তাসলিমা আখতার। এছাড়া পরবর্তী সময়ে আলোচনায় যুক্ত হয়েছিলেন অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া ক্যাম্পেইনার সাদ হাম্মাদি।
আলোচনায় ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলম নিখোঁজ হওয়ার আগে ভিডিও ফুটেছে কাজলের মোটরসাইকেল ঘিরে ঘোরাফিরা করা অজ্ঞাত লোকদের শনাক্ত করে আটকের দাবি জানান। একই সঙ্গে ব্যারিস্টার সারা হোসেন, কাজলের বিরুদ্ধে দুটি ডিজিটাল আইনে মামলা ও কাজলের পরিবারের পক্ষ থেকে অপহরণ মামলার কোনোটির অগ্রগতি নেই বলে জানান।
লাইভ আলোচনায় নিখোঁজের পর কাজলের সন্ধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ চেষ্টা করছে না বলে অভিযোগ করেন আলোচকরা।
তবে তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মুন্সী আবদুল লোকমান ১৯ এপ্রিল রাতে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখেছি, কল লিস্ট দেখা হয়েছে। সর্বশেষ (৯ এপ্রিল) উনার ফোন নম্বরটি চালু হয়েছিল বেনাপোল থেকে। একটা কলের পর আর সিগন্যাল পাওয়া যায়নি।’
তবে নিখোঁজ সাংবাদিক কাজলের ফোন নম্বর থেকে সর্বশেষ কলটি কাকে করা হয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু জানাতে চাননি তদন্ত কর্মকর্তা।
শফিকুল ইসলাম কাজলের ছেলে মনোরম পলক ১৯ এপ্রিল রাতে বলেন, ‘আমাদের একটাই চাওয়া। বাবাকে সুস্থভাবে আমাদের মাঝে ফেরত চাই। আমরা তার জন্য অপেক্ষা করছি।’ কাজলকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পরিবারের পক্ষ থেকে জোর দাবি জানানো হয়।
সূত্র-বাংলা ট্রিবিউন