নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপিতে বিরোধ এখন তুঙ্গে। দলটির ভিতরে এক পক্ষ চায় নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে অন্যপক্ষ চায় নির্বাচন বর্জন করতে। এরই মধ্যে বিএনপির একাধিক নেতা যারা দীর্ঘদিন ধরে দলের ভিতরে কোণঠাসা তারা নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। প্রয়োজনে তারা দল থেকে বের হয়ে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলে যোগদান করে কিংবা স্বতন্ত্র অবস্থান থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হওযার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও কেউ প্রকাশ্যে এখনও এই আলাপ করতে চান না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিএনপিতে বছরের পর বছর অবহেলার শিকার, বঞ্চিত, বিভিন্ন সময়ে দল থেকে নানা অজুহাতে বহিস্কার হওয়া, ওযান ইলেভেনের সময় সংস্কারপন্থি হওয়া , হতাশ সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ইতিমধ্যে নতুন দলে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন। কেউ কেউ নতুন দলে যোগ দিয়ে নেতৃত্বেও চলে আসছেন। বিশেষ করে প্রয়াত ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা হাতে গড়া দল তৃণমূল বিএনপির নেতৃত্বে এসেছেন বিএনপির সাবেক দুই প্রভাবশালী নেতা শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমুর আলম খন্দকার। এখন তাদের দেখানো পথ অনুসরণ করার জন্য প্রস্তুত নিচ্ছেন অনেক নেতা।
সূত্র জানায়, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে বিএনপির একটি বড় গ্রুপ আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মেজর হাফিজের সঙ্গে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন, কুমিল্লার সাবেক মেয়র বিএনপি থেকে বহিস্কৃত মনিরুল হক সাক্কুসহ আরও বেশ কয়েকজন গুরুত্ত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন। যারা এখনই তাদের নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না। তবে একাধিক নেতা বলেছেন, সময় সবকিছু বলে দিবে।
বিএনপির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, যারা বিএনপি ছেড়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনকৃত রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারেন। যাতে করে নির্বাচন করতে কোনোরকম ঝক্কিঝামেলা না হয়। আবার নিজ নিজ এলাকায় প্রভাবশালী এমন নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থীও হতে পারেন।
তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে যারা বিএনপি ছাড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপি বা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে (বিএনএম) যোগ দিতে পারেন। বিএনপির সাবেক নেতা ও মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার হাতে গড়া তৃণমূল বিএনপি কয়েক মাস আগে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়। কিন্তু এর কয়েক দিন আগেই মারা যান নাজমুল হুদা। এরপর দলটির হাল ধরেন তার কন্যা। সম্প্রতি দলটির নেতৃত্বে এসেছেন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী এবং বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার। তারা নেতৃত্বে আসার পর তেকেই আলোচনায় ওঠে এসেছে তৃণমূল বিএনপির নাম। দলের বর্তমান নেতৃত্ব দলকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছে।
এরই লক্ষ্য ধরে বিএনপির বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে তৃণমূল বিএনপির নেতাদের কথা হয়েছে। যাদের মধ্যে অনেকেই তৃণমূল বিএনপিতে যোগদানের কথা ভাবছেন। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখছে তৃণমূল বিএনপি।
সূত্র জানায়, বিএনপি থেকে তৃণমূল বিএনপি কিংবা বিএনএম এ যোগদানের জন্য কমপক্ষে অর্ধশত নেতা পাইল লাইনে রয়েছেন।
তৃণমূল বিএনপির নেতারা মনে করেন, বিএনপির যেসব নেতা নানাভাবে দলে উপেক্ষিত তাদেরকে দলে ভিড়াতে পারলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তৃণমূল বিএনপির গ্রহণযোগত্যা আরও বাড়বে। সে লক্ষ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন তৃণমূল বিএনপি নেতারাও সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। তারা আগামী নির্বাচনের জন্য সৎ যোগ্য এবং জনপ্রিয় প্রার্থীর সন্ধান করছেন। যারা নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারবেন।
তৃণমূল বিএনপির মত বিএনএম- এর নেতারাও তৎপরতা শুরু করেছেন নির্বাচনকে সামনে রেখে। তারাও চাচ্ছেন বিভিন্ন দল থেকে পদ বঞ্চিত যোগ্য নেতাদের নিজেদের ভিড়াতে। এই দলেও বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতাকে দেখা যেতে পারে। তবে কারা কবে যোগ দিবেন সে বিষয়ে এখনই কারো নাম প্রকাশ করতে চাচ্ছেন না দলটির নেতারা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি ছেড়ে ‘তৃণমূল বিএনপি বা বিএনএম-এ তে যোগদান করতে পারেন এমন নেতাদের মধ্যে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক মন্ত্রী মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ, দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী এহছানুল হক মিলন, যুগ্ম মহাসচিব ও সাবেক সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সরোয়ার, বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সাবেক সদস্য মনিরুল হক চৌধুরী, খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও দলের খুলনা মহানগরের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু, সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত সাবেক সংসদ সদস্য সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, আলী নেওয়াজ খৈয়াম, ডা. জিয়াউল হক মোল্লা, নূরুল ইসলাম মনি, নজির হোসেন, কুমিল্লার সাবেক মেয়র মনিরুল ইসলাম সাক্কু সহ আরও অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেছেন, বিএনপিতে এখন চরম সংকট যাচ্ছে। ভিতরে ভিতরে একাধিক গ্রুপ সক্রিয়। একটা বড় অংশ নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। আবার আরেক অংশ চায় আন্দোলন। এ নিয়ে বিরোধ এখন তুঙ্গে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসতে এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত কি হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
অপর একজন নেতা বলেন, দল দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে। কর্মীদের ধরে রাখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় নির্বাচনে যাবার কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচনের বিষয়ে দল যদি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে আগামীতে এর চড়া মূল্য দিতে হবে। এজন্য দলের নেতৃত্বকেই দায়ি করেন এই নেতা। তিনি বলেন, এখন রাজনীতির যে পরিস্থিতি তাতে নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। কারণ আন্দোলন করে সরকার পতন করা যাবে না। এর প্রধান কারণ ১৭ বছরেও বিএনপি আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ঘটাতে পারেনি। আবার বিদেশীরা যে ক্ষমতায় বসিয়ে দিবে এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই। বরং নির্বাচনে না গেলে দল হিসেবে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে।
এই নেতা আরও বলেন, দলের ভিতরে কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায়ে একাধিক নেতা রয়েছেন যারা নির্বাচনে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন। এই অবস্থায় দল কী সিদ্ধান্ত নেয় সেটা দেখার বিষয়।
এদিকে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার জানিয়েছেন, তাদের দলে যোগদানের জন্য বিএনপিসহ বিভিন্ন দল ও শ্রেণি-পেশার অনেক নেতাকর্মী ও সমর্থকরা যোগাযোগ করছেন। বিএনপি থেকে অন্তত অর্ধশত নেতা যোগ দিতে পারেন শিগগির। যাদের প্রায় প্রত্যেকেই এমপি প্রার্থী হওয়ার লাইনে আছেন।
আর বিএনএমের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুর রহমান জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দিবেন। এরমধ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন দল থেকে যারা বিএনএম-এতে যোগ দিতে চাচ্ছেন তাদেরকেও স্বাগত জানানো হবে।
অবশ্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলছেন ভিন্ন কথা। তার মতে, বিএনপির কোনো ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মী কোনো ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেবেন না। তার দাবি, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ঐক্যবদ্ধ।