রাজনৈতিক সংকট দূর করতে বিএনপি মাঝে মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানের কথা বললেও বরাবরই তার আগে একটি শর্ত জুড়ে দিয়ে আসছে। তাদের দাবি- নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি আওয়ামী লীগকে আগে মেনে নিতে হবে, তবেই সংলাপ হবে। না হলে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই তারা ফয়সালা করার হুঁশিয়ার বারবার দিয়েছে। তবে এদফা আর আগ বাড়িয়ে সংলাপের চিন্তা করছে না আওয়ামী লীগ। বিএনপি যদি কোনো শর্ত ছাড়া সংলাপ করতে চায়, আওয়ামী লীগ তখন ‘ভেবে দেখবে’ বলে জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।
দুই রাজনৈতিক দলের এমন অবস্থানের মধ্যে ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশ করে বিএনপি। শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হলেও রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা হয়। সংঘাত সহিংসতায় একজন পুলিশ সদস্যসহ দুজন মারা যায়। সহিংসতার ঘটনায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বহু নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আত্মগোপনে আছেন দলটির অনেক শীর্ষ নেতা। এরপরও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে তিনদিনের অবরোধ দিয়েছে বিএনপি। অনেকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেছেন- যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সাথে বিএনপি ও জামায়াতের নেতাদের একাধিক বৈঠকের পর নিজের শক্তিশালী ভেবেছিল বিএনপি। এজন্য রাজপথে সহিংস কর্মসূচির দিকে এগিয়েছে দলটি, পদদলীত করেছে সরকারের সাথে শর্তহীন সংলাপের পথটিও।
তবে নির্বাচন কমিশনের সাথে মঙ্গলবার বৈঠক শেষে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলো শর্তহীনভাবে সংলাপে বসবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করা- রাজনৈতিক দল, সরকার, ভোটার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সুশীল সমাজ, গণমাধ্যম এবং অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। যেকোনো পক্ষের রাজনৈতিক সহিংসতা গণতান্ত্রিক নির্বাচনে কোনো স্থান নেই। আমি আশার করি সব পক্ষ শর্তহীনভাবে সংলাপে বসে সামনে দিকে এগুবে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পথ খুঁজে নেবে।’
স্বভাবতই এখন প্রশ্ন উঠেছে- এতো দিন যে দলটি শর্তহীন সংলাপ বসতে চায়নি, সেই দলটি পিটার হাসের কথায় সংলাপে বসবে? আর কেনই বা পিটার হাস নির্বাচন কমিশনে গিয়ে বৈঠক করলেন, আর শর্তহীন সংলাপের কথা বললেন। ২৮ অক্টোবর সহিংসতার পর কার্যত নিশ্চুপ ছিল মার্কিন দূতাবাস। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কথিত উপদেষ্টার পরিচয় দিয়ে বিএনপির মিথ্যাচার নিয়েও টু শব্দ পর্যন্ত করেননি পিটার হাস। সেই তিনি মঙ্গলবার ছুটে গেলেন নির্বাচন কমিশনে। আশা করলেন- সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলো শর্তহীন সংলাপে বসবেন। এরআগে বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসার পরামর্শ দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দল। কিন্তু বিএনপি শর্তহীন সংলাপকে বারবার ‘না’ বলেছে। সেই বিএনপি কী এখন পিটার হাসের কথায় এখন সরকারের সাথে সংলাপে বসবে?
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ না হওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে বারবার দায়ী করে আসছে বিএনপি। দলটির যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বিবিসি বাংলাকে বলছেন, ‘তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নমনীয় হলেই সমঝোতার পরিবেশ তৈরির পথ উন্মুক্ত হতে পারে। আওয়ামী লীগ বড় রাজনৈতিক দল। তারা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। তাই তাদের নমনীয় হওয়াটাই প্রত্যাশা করে সবাই।’ অর্থাৎ সংলাপ বা সমঝোতার জন্য বিএনপির দিকে থেকেও বড় শর্ত আছে এবং তা হলো আলোচনায় বসার আগেই আওয়ামী লীগকে বিএনপির প্রধান দাবিটি মানা হবে- এমন নিশ্চয়তা দিতে হবে।
বিএনপি যদি কোনো শর্ত ছাড়া সংলাপ করতে চায়, আওয়ামী লীগ তখন ‘ভেবে দেখবে’ বলে জানিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গত ১২ অক্টোবর সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে তিনি বলেন, “সংলাপের চিন্তা আমরা করব তখন যখন তারা (বিএনপি) এই চারটি শর্ত যদি তারা প্রত্যাহার করে নেয়। শর্তযুক্ত কোনো সংলাপের ব্যাপারে আমাদের কোনো চিন্তাভাবনা নেই। শর্ত তারা প্রত্যাহার করলে তখন দেখা যাবে।” অর্থাৎ সংলাপ হতে পারে, তবে সেটি হতে হবে শর্তহীন। দাবি নেমে নেয়ার পর আলোচনা এটা কখনো হতে পারেনা।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক সংকট দূর করার জন্য সংলাপ হয় ১৯৯৪ সালে। ২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ-বিএনপি মহাসচিব পর্যায়ের সংলাপহয়। ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপ হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যফ্রন্টের সংলাপ হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে। সবগুলোই সংলাপ হয়েছে শর্তহীন ভাবে।
বিএনপির বর্তমান অবস্থা বাংলা প্রবাদের মতো ”সাধলে জামাই খান না, না-সাধলে জামাই পান না”। এতো দিন শর্ত মানলে তবেই সংলাপে বসতে চেয়েছিল বিএনপি। আর তখন আওয়ামী লীগ বলেছিলন- “শর্ত দিয়ে সংলাপ হয়না।” তবে মঙ্গলবার পিটার হাস- সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলো শর্তহীনভাবে সংলাপে বসবে বলে আশা প্রকাশ করেন। কিন্তু আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সেই আশায় ”গুড়ে বালি” দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বেলজিয়াম সফর নিয়ে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলনে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রশ্নোত্তর পর্বে ইটিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান- মঙ্গলবার পিটার হাস নির্বাচন কমিশনে গিয়ে রাজনৈতিক সংকট সমাধানে শর্তহীন সংলাপের কথা বলেছেন সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী কী বলতে চান। এসময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুনিদের সঙ্গে কিসের সংলাপ? বরং সে (পিটার হাস) বসে ডিনার খাক, সে সংলাপ করুক। আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। এটা বাংলাদেশের মানুষও চাইবে না। বাংলাদেশের মানুষ বিএনপি জামাতকে ঘৃনা করে। যেটুকু সুযোগ পেয়েছিলো, আমরা করে দিয়েছিলাম সুযোগ সেটাও হারিয়েছে। যখন উপ-নির্বাচনে হিরো আলমকে কেউ মেরেছিলো তার বিচার দাবি করেছিলো। এখন যখন পুলিশকে পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হলো তখন কেনো বিচারের দাবি করে না। যারা সাংবাদিকদের সুরক্ষার কথা বলে। আজকে যখন এতো সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হলো তারা চুপ কেনো?’
প্রধানমন্ত্রীর কথায় পরিস্কার বিএনপির সাথে কোনো সংলাপে বসবে না বর্তমান সরকার। সেটি শর্তহীন হোক বা শর্তযুক্ত হোক। সেই সাথে যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রদূতকে এক হাত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, “ট্রাম্প সাহেবের সঙ্গে বাইডেন সংলাপ করছে? ট্রাম্প বাইডেনের সংলাপের দিন আমরাও সংলাপ করবো।” ২৮ অক্টোবর সহিংসতার পর বিএনপির এখন “আমও গেল ছালাও গেল”। নির্বাচনে অংশগ্রহণ ছাড়া বিএনপির সামনে আর কী কোন পথ খোলা আছে? সেই প্রশ্নের উত্তর জানতে অপেক্ষা করতে হবে নভেম্বর পর্যন্ত।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।