ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য দেখানো সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা বিজয়ী দলের খেলোয়াড় নিলুফার ইয়াসমিন নীলা এখন কুষ্টিয়াবাসীর গর্ব ও অহংকার। ক্রীড়াঙ্গনে সাফল্য দেখানো কুষ্টিয়ার অন্যান্যদের তালিকায় নারী খেলোয়াড় নিলা সাফল্য অর্জনের পাশাপাশি মুখ উজ্জল করেছেন কুষ্টিয়াবাসীর।
কুষ্টিয়ার মাটিতে দরিদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা ও সামাজিক কুসংস্কার-প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্যান্য খেলাধুলাসহ ফুটবল খেলায় তিনি এখন সফল নারী খেলোয়াড় হিসাবে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। উদ্যমী ও সাহসী এই নারী ফুটবলারের সাফল্যে আনন্দে ভাসছে তার পরিবার ও এলাকাবাসী।
রিক্সাচালক বাবা তার মাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নিলুফার বয়স ছিল মাত্র আড়াই বছর ও তার ছোট বোন সুরভী আক্তারের বয়স তখন ছিল মাত্র দেড়মাস। সে সময় মা বাছিরন আক্তার দুই মেয়ে নিয়ে চোখে-মুখে অন্ধকার দেখেন। সাহস বুকে নিয়ে মা বাছিরন নিলুফারের নানী বাড়ি কুষ্টিয়া শহরের থানাপাড়া এলাকায় কুঠিপাড়া চরে আশ্রয় নেন। তিনি শহরের একটি ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে সামান্য বেতনে একটি চাকরিও শুরু করেন।
মায়ের ইচ্ছে ছিলো মেয়ে দুটোকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। নিলুফা ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলায় পারদর্শি ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সে নানা খেলায় সাফল্য দেখিয়েছেন। উচ্চ লাফ,দৌড়সহ প্রায় সব ধরণের খেলায় পারদর্শিতায় নিলুফার মা বাছিরন মেয়েকে ক্রীড়াবীদ হিসেবে তৈরির ইচ্ছা পোষন করেন।
তিনি মেয়েকে উৎসাহ ও সাহস দিতে থাকেন। কুসংস্কারছন্ন সমাজে নিলুফাকে খেলোয়াড় বানাতে তার পরিবারকে নানা নেতিবাচক কথাও শুনতে হয়েছে।
কুষ্টিয়া শহরের চাঁদ সুলতানা স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করার পর মিরপুর উপজেলার আমলা সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন নিলুফা। পরে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কুষ্টিয়ার আরেক কৃতি সন্তান আবু ফাত্তাহ ছিলেন ফুটবল ফেডারেশনের কর্মকর্তা। তিনি শহরের কুঠিপাড়া এলাকায় নিলুফারের ফুটবল খেলা দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে উৎসাহ দেন। ঢাকায় প্রশিক্ষন ও ভর্তিবাবদ যাবতীয় সহযোগিতা করেন তিনি ।
ফুটবলে সাফল্য দেখানো নিলুফা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে অর্থ পুরস্কারও পেয়েছেন। সেই অর্থ দিয়ে জমি কিনে জুগিয়া ফার্মপাড়ায় বাড়ি তৈরী শুরু করেছেন।
বর্তমানে কুষ্টিয়া পৌরসভার জুগিয়া এলাকায় বসবাসরত নিলুফারের মা বাছিরন জানান, ‘আমার মেয়ে জাতীয় দলে ফুটবলার একথা এলাকার অনেকেই জানতেন না। এমনকি শহরেরও অনেকে জানতো না। কিন্তু সাফ নারী ফুটবলে শিরোপা লাভের পর থেকে আমার বাড়িতে অনেক সাংবাদিক, এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি, পৌর কাউন্সিলরসহ অনেকেই আসছেন। আগেই যারা নিলুফাকে নিয়ে নেতিবাচক কথা বলেতেন, তাদের অনেকে ক্ষমাও চেয়েছেন।’
কুষ্টিয়া পৌরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র শাহিন উদ্দিন নিলুফার বাড়ি যাওয়ার পথটি নিজ খরচে আছাগামুক্ত ও চলাচল উপযোগী করেছেন। এছাড়া তার বাড়ির উঠানের পানি নিষ্কাশন ও জলবদ্ধতা নিরসনে বালু ফেলে উঁচু করে দিয়েছেন। এতে নিলূফার মা বাছিরন আক্তার বেশ খুশি।
নিলুফা ইয়াসমিন নীলা বলেন, খেলাধুলা দেখতে ভালো লাগে। ছোটবেলায় টিভিতে ফুটবল খেলা উপভোগ করতাম। পরবর্তীতে নারীদের ফুটবল খেলা দেখে কেমন যেন মনে হতো এটাও কি সম্ভব। এক সময় দেখি নারীরাও ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি ফুটবল খেলায়ও এগিয়ে যাচ্ছে। তাই ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন সময় ফুটবল খেলায় নাম লেখায়। এরপর অনূর্ধ্ব-১৪ তে কুষ্টিয়া জেলার হয়ে চুয়াডাঙ্গায় ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণ করি। এরপর রাজশাহীতেও ফুটবল খেলেছি। প্লানের ক্যাম্পেও অংশগ্রহণের পর জাতীয় দলে অংশগ্রহণ করি। গেলোবারে সাফ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে শক্তিশালী ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশি কিশোরীরা চ্যাম্পিয়ন অর্জন করতে পেরে আমরা পুরো জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা আনন্দিত। সম্প্রতি সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপাজয়ী দলের সদস্য হিসেবে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। নীলার আক্ষেপ আমাকে কুষ্টিয়ার প্রশাসন কিংবা জনপ্রতিনিধি তেমন কেউ চেনে না বা জানেনা বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
কুষ্টিয়া জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট অনুপ কুমার নন্দী জানান, ‘নিলার সাফল্যে আমরা কুষ্টিয়াবাসী গর্বিত।’ সাফজয়ী এই ফুটবলারের পাশে জেলা ক্রীড়া সংস্থা সব সময় থাকবে বলেও তিনি জানান।
কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম জানান, ‘কুষ্টিয়ার নারী ফুটবলার নিলুফার সাফল্যে আমরা গর্বিত।’ জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মামনা দেয়ার পরিকল্পনা করা রয়েছে বলেও তিনি জানান।
জাতীয় ও বয়সভিত্তিক দলের নিয়মিত মুখ নিলুফা ইয়াসমিন নীলা খাতুন কুষ্টিয়ার সন্তান। তাই তাদেরকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ প্রদান করতে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদেরতদের পাশে দাঁড়ানো উচিৎ বলেও মনে করেন সচেতনমহল।