চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়ির আউটার স্টেডিয়াম। মাঠের এক কোণে মূল স্টেডিয়ামের ফ্লাড লাইটের টাওয়ার। টাওয়ারের পাশে ছোট ছোট শিশুদের জটলা। মধ্যবয়স্ক এক লোককে ঘিরে ধরেছে তারা। ফরসা গা, সোনালি চুলের লোকটিকে দেখেই বোঝা যায় বিদেশি। ঘিরে ধরা পথশিশুদের কেউ তাঁর কাছে খেলাচ্ছলে বর্ণমালা বা সংখ্যা শিখছে, কেউবা মেতেছে ছোটখাটো খেলায়। খেলার যাবতীয় উপকরণ নিয়ে এসেছেন ইতালীয় ভদ্রলোক ব্রাদার লুসিও।
তাঁর গায়ে টিশার্টে লেখা ‘পথশিশুদের সেবায় এগিয়ে আসুন’। ‘পথশিশু সেবা সংগঠন’ নামে একটি সংস্থার মাধ্যমে এই কার্যক্রমটি ১২ বছর ধরে চালাচ্ছেন লুসিও। ঢাকা ও সিলেটের পর এক মাস ধরে চট্টগ্রামে পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছেন লুসিও।
স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এই কাজ করেন তিনি। এ জন্য ঢাকায় প্রায় সাড়ে ৮০০ স্বেচ্ছাসেবক পেয়েছেন। আর গত ১২ বছরে সেবা দেওয়া হয়েছে প্রায় ১২ শ পথশিশুকে। সিলেটে তাঁর স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে দেড় শর মতো।
সংগঠনটি পথশিশুদের চিকিৎসা, পড়ালেখা, স্কুলে ভর্তি, পুনর্বাসনের পাশাপাশি পরিবারে ফিরিয়ে দেওয়ার কাজ করে থাকে। এ ছাড়া চিত্রাঙ্কন, খেলাধুলা, বেড়ানো, বনভোজন সবকিছুই রয়েছে শিশুদের জন্য। আয়োজন করা হয় শিশুচলচ্চিত্র উৎসবেরও।
পথশিশুদের এসব সেবা দেওয়ার ব্রত নিয়ে লুসিও এখন চট্টগ্রামে। সোমবার স্টেডিয়ামের পাশে রাস্তায় বসে যখন পথশিশুদের বর্ণমালা শেখাচ্ছিলেন অনেকেই তখন উঁকি দিচ্ছিলেন। লুসিও বলতে থাকেন, ‘পথশিশু আমার সৃষ্টি, তোমার সৃষ্টি। কেন তারা রাস্তায় ঘুমাবে? আমরা একটা বন্ধন তৈরি করতে চাই। তাদের মানবপ্রেমী করতে চাই। কোনো ভেদাভেদ চাই না। ধনী–গরিব, লম্বা-বেঁটে কোনো ভেদাভেদ নয়।’
আসমা নামে ৬ বছরের এক শিশুকে হাতেকলমে ব্যঞ্জনবর্ণ চেনাচ্ছিলেন লুসিও। বর্ণগুলো কাঠের তৈরি। আসমা যখন ঠিক ঠিক বলতে পারছিল, তখন লুসিও উল্লাসে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলছিলেন, ‘খুব ভালো।’
লুসিও বলেন, ‘সব শিশুর অধিকার রয়েছে। আমি সৃষ্টিকর্তার নির্দেশে পথশিশুদের হয়ে কাজ করতে এসেছি। থাকি ঢাকায় এক বস্তিতে। চট্টগ্রামে এখনো কোনো স্বেচ্ছাসেবক পাইনি। ছয় মাস দেখব। যদি কাজ চালানোর মতো স্বেচ্ছাসেবক পাই তাহলে কাজ চালিয়ে যাব।’ এ জন্য তিনি বিভিন্ন কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
লুসিও ইতালি থেকে ১৮ বছর আগে এ দেশে আসেন। পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার লুসিও প্রথম দিকে দিনাজপুরে একটি স্কুলে পড়াতেন। এরপর ২০১৭ সাল থেকে পথশিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। তিন বছর পরপর তিনি নিজ দেশ ইতালিতে যান। এক বছর আগে তিনি বাংলাদেশি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন।