জগৎ সংসারের শত দুঃখ আর কষ্টের মাঝে যার একটু সান্ত্বনা আর অনুপ্রেরণা আমাদের সমস্ত বেদনা দূর করে দেয়, দুঃখে-কষ্টে, সংকটে-উত্থানে যিনি মাথার উপর ছাঁয়া হয়ে দাড়াঁন তিনিই হলেন পিতা।
হযরত আবু দারদা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রসূলাল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এই এরশাদ করতে শুনেছি, পিতা জান্নাতের দরজাসমূহের মধ্য হতে উত্তম দরজা। অতএব তোমার ইচ্ছা, এই দরজাকে ধ্বংস করে দিতে পার। অথবা এই দরজাকে রক্ষা করতে পার। (তিরমিযী)
ইসলামে পিতার আনুগত্য ও মর্যদার প্রতি খেয়াল রেখে সদ্ব্যবহার ও আদব রক্ষা করে চলা সন্তানের উপর অপরিহার্য।
হযরত ইব্রাহীম আলাইহিসসাল্লামের অবস্থা দেখুন! তিনি প্রতিদিন সকালে ও সন্ধায় দেখতেন যে, নিষ্প্রাণ মূর্তিগুলোকে আমার পিতা নিজের হাতে তৈরী করেন। এবং তার যেমন ইচ্ছা হয় নাক, কান, চোখ এবং দেহাবয়ব কাটেন, ফুটা করেন এবং জোড়া লাগান। তারপর ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। তাহলে, এগুলো কি খোদা হতে পারে? কিম্বা খোদার সমতুল্য ও সমকক্ষ বলা যেতে পারে? কখনও না, এরপর নবুওত লাভ করে সর্বপ্রথম তিনি এদিকেই মনোযোগ দিলেন।
আর মূর্তি পুজার বিপক্ষে যখন হযরত ইব্রাহীম আলাইহিসসাল্লামের সথে তাঁর পিতার বির্তক হয়ে গেল তখন তাঁর পিতা তাকে বললেন, কুরআনের ভাষা: ‘ইব্রাহীম! তুমি কি আমার খোদাদের প্রতি অসন্তুষ্ট? তুমি যদি এমন কাজ থেকে নিবৃত্ত না হও, তবে নিশ্চয় তোমাকে প্রস্তর নিক্ষেপে চুর্ণ-বিচুর্ণ করে দিব। যাও, আমার সম্মুখ থেকে দূর হয়ে যাও।’(সুরা মরইয়াম; ৪৬)
এমন কঠোর ও মনোবেদনাদায়ক কথোপকথনের সময়ও হযরত ইব্রাহীম আলাইহিসসাল্লাম পিতার সম্পর্কের মর্যদা রক্ষা করে বলেছেন যে, কুরআনের ভাষা: ‘আপনার প্রতি শান্তি বর্ষিত হউক। অচিরেই আপনার জন্য আমি আমার রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব। নিঃসন্দেহ, তিনি আমার প্রতি সতিশয় দয়াবান।’(সুরা মরইয়াম; ৪৭)
দেখুন মহান আল্লাহ তা’য়ালা পিতার প্রতি এতটায় এহছান করেছেন যে, পিতা সন্তানদেরকে আল্লাহর সাথে শরিক করতে বলার পরও তার সাথে ইহসানের আচরণ করতে বলেছেন।
একবার রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খেদমতে এক ব্যক্তি আসল তার সাথে একজন বৃদ্ধ লোক ছিল। রসূলাল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে অমুক, তোমার সাথে এই বৃদ্ধ লোকটি কে? সে বললো, ইনি আমার পিতা।
তিনি বললেন, তার সম্মুখে হেঁটো না, তার পূর্বে বসো না, তার নাম ধরে ডেকো না, এবং তাকে গালি দেওয়ার কারণ হয়ো না।(অর্থাৎ তুমি কারো পিতাকে গালি দাও, আর সে জবাবে তোমার পিতাকে গালি দেয়) (হায়াতুস সাহাবাহ)
আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু একদিন দেখতে পেলেন, দু’জন লোক রাস্তা দিয়ে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন অন্যজন থেকে অধিকতর বয়ষ্ক। কনিষ্ঠজনকে ডেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সংগের লোকটি তোমার কে? সে বলল ‘আব্বা।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কখনও তার নাম ধরে ডাকবে না, তাঁর আগে আগে চলবে বা এবং তাঁর বসার আগে কোথাও বসবে না।’
ইবনে মুহাইরিয রহমাতুল্লাহি আলাইহি অনেক উন্নত স্বভাব-চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি বলেন, পিতার পথ থেকে কোনো কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরানোর উদ্দেশ্য ছাড়া তাঁর আগে চলা তার অবাধ্যতার নামান্তর।
ওমর ইবন যরকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনার প্রতি আপনার ছেলের আনুগত্য বা সদ্ব্যবহারের অবস্থাটা কেমন ছিল? তখন তিনি বললেন, আমি দিনের বেলায় হাঁটলে সে আমার পিছনে পিছনে হাঁটত; আর রাতের বেলায় হাঁটলে সে আমার সামনে সামনে হাঁটত; আর আমি নিচে থাকলে সে কখনও ছাদের উপরে উঠত না।’(উয়ুনুল আখবার)
পিতার অবাধ্য হলে দুনিয়াতেই তার শাস্থি পাওয়া যায়।
আর আসমা’য়ী বলেন, আরবের এক ব্যক্তি আমার নিকট বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি সবচেয়ে অবাধ্য মানুষ ও সবচেয়ে অনুগত মানুষের সন্ধানে বের হলাম; অতঃপর আমি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম, শেষ পর্যন্ত আমি দ্বিপ্রহরে প্রচণ্ড গরমের সময় এক বৃদ্ধের দেখা পেলাম, পানি উঠানোর জন্য যার গলায় রশি দিয়ে বালতি বেঁধে দেওয়া হয়েছে, যা টেনে উঠানো উটের পক্ষেও সম্ভব নয়, আর তার পিছনে চামড়ার পেঁচানো রশি (চাবুক) হাতে এক যুবক তাকে প্রহার করছে; আর সে এ রশি দ্বারা পিটিয়ে তার পিঠ রক্তাক্ত করে ফেলেছে। অতঃপর আমি বললাম, তুমি কি এই দুর্বল বৃদ্ধের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করনা? তার ঘাড়ে রশি লাগিয়ে দেওয়াটা কি যথেষ্ট হয়নি যে, তুমি তাকে আবার প্রহার করছ?
তখন সে বলে, তাতো আমি আমার পিতার সাথে এই ব্যবহার করছি(তাতে তোমার কি); তখন আমি বললাম: তাহলে তো আল্লাহ তোমাকে ভালো পুরস্কার দিবেন না।
তখন সে বলল, চুপ কর, সে তো তার পিতার সাথে এরূপ ব্যবহার করত; আর তার পিতাও তার দাদার সাথে অনুরূপ ব্যবহার করত; তখন আমি বললাম: এই হলো সবচেয়ে অবাধ্য মানুষ।
অতঃপর আমি ঘুরতে লাগলাম, শেষ পর্যন্ত দেখা পেলাম এক যুবকের, যার ঘাড়ে একটি ঝুড়ির মধ্যে রয়েছে এক বৃদ্ধলোক, মনে হচ্ছিল যেন একটি মুরগীর বাচ্চা; তারপর সে সব সময় তাকে তার সামনে রাখত এবং তাকে খাওয়াতো যেমনিভাবে মুরগীর বাচ্চাকে খাওয়ানো হয়; তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম: উনি কে? সে বলল: আমার আব্বা, বয়সের ভারে তার বুদ্ধি লোপ পেয়েছে, আমি তাকে দেখাশুনার দায়িত্ব নিয়েছি; তখন আমি বললাম, এই হলো আরবের সবচেয়ে অনুগত ও ভাল মানুষ।(ইবরাহীম আল-বায়হা ‘আল-মাহাসেন ওয়াল মাসাওয়ী)
ছাবিত বুনানী রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, তিনি এক ব্যক্তিকে দেখলেন, কোনো এক স্থানে সে তার পিতাকে প্রহার করছে। তখন সেই ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা হলো, ব্যাপার কী? এখানে এনে তোমার পুত্র তোমাকে প্রহার করছে কেন? পিতা বলল তাকে ছেড়ে দাও। কারন আমি আমার পিতাকে এই স্থানে প্রহার করেছিলাম। সুতরাং তার প্রায়শ্চিত্ত স্বরুপ আমার ছেলেও আমাকে ঠিক ঐ স্থানে মারছে। তার কোনো দোষ নেই।(তাম্বীহুল গাফেলীন)
আল্লাহ তা’য়ালা আমাদেরকে পিতার হক আদায়ের দ্বারা মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের তাওফীক দান করুন।(আমীন)
আল্লাহই সর্বজ্ঞ।
লেখক:
বায়োকেমিস্ট, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রনালয়, খুলনা